» মহানবী হইতেই অলি-আল্লাহর বুজুরর্গী
হজরত রাছুলুল্লাহ হইতেই অলি-আল্লাহ সকল বুজুরর্গী লাভ করিয়া থাকেন। তাঁহারই অনুগ্রহ-কণাতে কত প্রেমিক কত উচ্চ স্থান লাভ করিয়াছেন। হজরত পীরাণ পীর গওছুল আজমযিনি অলিশ্রেষ্ঠ ছিলেন, যাঁহার কারামতে শুমার নাই, যাঁহার ছেল-ছেলায় ধরাবক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ মোছলেম অন্তর্ভুক্ত, তিনি বুজুরগী পাইয়াছেন আঁ-হজরত (দ:) হইতে। আঁ-হজরতের সামান্য নেকদৃষ্টি পাইলে প্রেমিক মালামাল হইতে পারে। আঁ-হজরতের করুণা পাইলে খোদার প্রেম-লাভ অবশ্যম্ভাবী।
আঁ-হজরত (দ:) হইতেই পীর মুর্শিদের কামালিয়ত। তাঁহারই অনুগ্রহে পীর-মুর্শিদ অনুগৃহত। পীরের প্রতি সাচ্চা মহব্বত হইলে আঁ-হজরতের প্রতি মহব্বত অনিবার্য্য। আবার আঁ-হজরতের প্রতি মহব্বত হইলে খোদার মহব্বত অনিবার্য্য। মহব্বত খোদাতায়ালার খাছ দান। এই মহব্বতের পীর, অলি-আল্লাহ, হাবিব ও মাহবুব সকলেই শৃঙ্খলাবদ্ধ। যিনি সাচ্চা মহব্বত এখতেয়ার করিয়াছেন, তিনি খোদার অনুগ্রহ লাভ করিয়াছেন, অলি-আল্লাহর সাহায্য পাইয়াছেন।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ২৪।
হিন্দু সাধুদের একটি প্রবাদ-বাক্য আছে, ‘ভগবান ভক্তের ভক্ত’। যিনি খোদার প্রিয়, খোদাও তাঁহার প্রিয়। অলি-আল্লাহ খোদার আশেক, আবার খোদাও অলি-আল্লাহর আশেক। দুনইয়ায় এশক হইতে অদিকতর মূল্যবান নেয়ামত আর নাই। যিনি এশকের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন, তিনি খোদাতক পৌঁছাইয়াছেন। বাহ্য চক্ষুতে আমরা খোদাকে দেখি না, রাছুলুল্লাহকেও দেখি না, দেখি পীরকে। যদি পীর খোদার আশেক হন, তবে তাঁহারই যোগে হজরত রাছুলুল্লার দীদার লাভ করা যায়, আবার হজরত রাছুলুল্লার মধ্যবর্ত্তিতায় স্বয়ং খোদার নৈকট্য লাভ হয়। যিনি পীরকে হারাইয়াছেন, তিনি সব কিছু হারাইয়াছেন।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) (১৯৯৩), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ২৫।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ “যে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা (তাঁর নৈকট্য লাভ হেতু) উসিলা অন্বেষণ কর এবং (স্বীয় নফসের সহিত) জিহাদ কর; নিশ্চয়ই তোমরা সফলতা লাভ করবে।” (সূরা মায়েদা- আয়াত ৩৫)
ব্যাখ্যাঃ মানব দেহে রূহ এবং নফসের একত্র সমাবেশ। দেহ রোগগ্রস্ত হলে যেমন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় এবং চিকিৎসকের নির্দেশ মুতাবিক ঔষধ ব্যবহার করতে হয়, আহারে-বিহারে পরহেয করতে হয়, তেমনি আত্মা রোগগ্রস্ত হলে আত্মার রোগে চিকিৎসক হচ্ছে কামিল পীর মুরশিদ। তিনি তালকিন (দীক্ষা) দিয়ে নফসের ধোকা হতে বাঁচবার পন্থা শিক্ষা দেন এবং আত্মার উন্নতি কিসে হবে তারই নির্দেশ দান করেন। তাঁদের সহবত (সঙ্গ) এবং মুখনিঃসৃত বাণীসমূহ রুগ্ন-আত্মার উপর ঔষধস্বরূপ ক্রিয়া করে। সে মুরিদ পীরের অধিনায়কত্ব বরণ করে সে মুরিদের আত্মা ঐ কামিল পীরের তত্ত¡াবধানে থেকে ক্রমশ ইনসানই কামিলে পরিণত হয়।
আল্লাহ পাক বলেছেন ঃ “তিনি রহমান (দয়াময় আল্লাহ) সম্পর্কে ওয়াকিবহাল (জ্ঞাত) তাঁরই নিকট আল্লাহর সন্ধান কর।” (সূরা মায়েদা- আয়াত ৫৯)
ব্যাখ্যাঃ উপযুক্ত পীরের কামিলের নিকট তরকিন গ্রহণ করে প্রথম স্বীয় জিহŸা দ্বারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার সহিত তন্ময় থাকার অভ্যাস করা পীরের শিক্ষায় লাভ হয়। এই অভ্যাস ক্রমশ স্বভাবে পরিণত হয়ে জীবিত অন্তঃকরণ লাভ হয় এবং অভ্যন্তরীণ জিহŸা উক্ত কালেমার সহিত পরিপূর্ণ অন্ময়তা লাভ করার পর ইনসানে হাকীকী (অভ্যন্তরীণ প্রকৃত মানুষ)-এর অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। এরই যোগে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক নিকটতর হয়। বিশিষ্ট বুযুর্গানে দ্বীনের অভিমত- ‘যাঁরা পীরে কামিলের মজলিসে উপবেশন করে তারা যেন আল্লহর মজলিসে উপবেশন করল।’ ওলী-আল্লাহগণের দিল সর্বক্ষণই আল্লাহর সহিত সম্পর্কবিশিষ্ট এবং বাতিনী যিকিরে ইলাহিতে মশগুল থাকে। কেবল যাহিরী ইল্্ম দ্বারা আল্লহতত্ত¡জ্ঞান লাভ হয় না। সুতরাং ইনসানে কামিল হতে হলে যাহির ও বাতিন-উভয়বিধ ইল্্ম হাসিল করা কর্তব্য। যাহিরী ইল্্ম শিক্ষার জন্য যেমন শিক্ষাগারসমূহ আছে, তেমনি বাতিনি ইল্্ম শিক্ষার জন্য পীরের খানকা নির্দিষ্ট।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “[হে মুহম্মদ (সা:)!]” বলুন, এই আমার পথ, সকলকে আল্লাহর নিকট আহŸান করি প্রজ্ঞার সাথে; আমি ও আমার অনুসারিগণ ধর্মের উত্তম পথের উপর রয়েছি।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত ১০৮)
হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেনঃ “পাখীগুলি যেমন দুইবার জন্মগ্রহণ করে (একবার ডিম দেয় পারে বাচ্চা হয়)। তেমনি মানুষ দুইবার জন্মগাহণ না করলে আসমানসমূহের মালাকুতে প্রবেশ করতে পারবে না। ইহার মর্ম পিতা-মাতার ঔরসে এক জন্ম, পরিণত বয়সে পীরের নিকট বায়আত গ্রহণ করা দ্বিতীয় জন্ম। কেননা পীরের তালকিন ব্যতীত হাকীকতে ইনসানিয়াত লাভ হয় না। হযরত পীরানে পীর সৈয়দ আব্দুল কাদির জীলানী (র:) সিররুল আসরারে আরও বর্ণনা করেছেন, (প্রকাশ্য) আলিম পবিত্র হেরেমে প্রবেশ করতে পারবে না (পৃঃ ১৭)। তরীকায়, প্রবেশ কর। এই রূহানীয়াতের কাফেলাসমূহের অনুসরণ করে স্বীয় প্রভুর দিকে প্রবেশ কর। এই রূহানীয়াতের কাফেলাসমূহের অনুসরণ করে স্বীয় প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন কর। শীঘ্রই তরীকার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এবং ঐ জগতের সঙ্গী পাওয়া যাবে না। (সিররুল আসরার, পৃঃ ১২)
তথাসূত্রঃ ডা: কাজী আবদুল মোন্য়েম, ইসলামের আলোকে সূফীবাদ ও সাধনা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন(১৯৮০); পৃঃ ৩১-৩২।
হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) বলেন, পীর-মুরীদের মধ্যে দুনইয়াদারী থাকা নেহায়েত আক্ষেপের বিষয়। শিষ্যত্ব দান বা গ্রহণ লিল্লাহ্্ কেবল খোদারই ওয়াস্তে হওয়া উচিত। যেখানে লিল্লাহিয়ত নাই, সেখানে প্রকৃতত্ব নাই। অনেকে যোগ্যতা অযোগ্যতা দেখে না, সকলেই রছমের বশবর্ত্তী হইয়া কাজ করে। আমি এই রছমের পক্ষপাতী নহি। আমি নিজেকে অসম্পূর্ণ জানি, আমি কিরূপে অন্য ব্যক্তিকে সার্টিফিকেট দিব এবং সেই সার্টিফিকেটের বলে অপরের প্রলুব্ধ হইয়া তাহাকে সম্মান করিবে ও খলিফা বলিয়া গণ্য করিবে?
সারা বঙ্গে কত পীর, কত মাওলানা বর্ত্তমান, যে কেহ যথাতথা উপস্থিত হইতে পারে ও মুস্তাফীজ হইতে পারে। প্রত্যেকে স্ব স্ব বিবেক অনুসারে কার্য্য করিতে পারে, আমি কেন নিজের মাথায় নিজের পাগড়ী পরিয়া অপরকে প্রলুব্ধ করিব, কিংবা আমার পরবর্ত্তীকে নির্দ্দিষ্ট করিয়া লোকের বিবেকের বিরুদ্ধে তাঁহারই হেদায়েত গ্রহণ করিতে বাধ্য করিব? আমি নিজে জানি আমি কত নালায়েক, তাই অপরের হাত ধরিতে সাহসী হই না। যাঁহারা বল রাখেন, তাঁহারাই দুর্ব্বলের হাত ধরিয়া গন্তব্য স্থানে পৌঁছাইতে পারেন।
আমি মুক্তকন্ঠে সবাইকে বলিয়া থাকি-যিনি যেখানে ইচ্ছা হেদায়েত প্রাপ্তির জন্য উপস্থিত হইতে পারেন, বায়াত লইতে পারেন, কেনা-বেচা একবার মাত্র চলিতে পারে। যিনি নিজেকে একবার কাহারও নিকট বিক্রয় করেন, তিনি পুনরায় অপরের নিকট নিজেকে বিক্রয় করিতে পারেন না। তাই আমি নিজের হীনত্ব লইয়া দূরে থাকি, কাহারও কাছে হাত বাড়াইতে সাহস করিনা। যাঁহার যথা ইচ্ছা যাইতে পারেন, বায়াত লইতে পারেন। আমি কেবল আগন্তুকের ব্যথা দিবার ভয়ে সাধারণ উপদেশ দিয়া ক্ষান্ত থাকি, কেহ ইচ্ছা করিলে গ্রহন করিতে পারেন, বা অন্যত্র বায়াত লইয়া খেলাফতি কবুল করিতে পারেন। আমি কাহাকেও খলিফা মনোনীত করিতে চাহি নাই কেন অপরে স্ব স্ব বিবেককে বিক্রয় করিয়া আমারই মনোনীত ব্যক্তিকে হাদীর পদে স্থান দিবে ? খোদা যাঁহাকে হেদায়েত করিবার উপযোগী করিবেন, লোক সেখানে স্বতঃই ছুটিয়া আসিবে, অপরে তাঁহাকে ঘোষণা করুন বা না করুন। স্বীয় শক্তি বলে ঘোষণা দ্বারা কাহাকেও খলিফা পদে অতিরিক্ত করা অযৌক্তিক কনে করি। একবার কাহারও নিকট বায়াত হইলে পুনঃ অপরের নিকট বায়াত হওয়া অনুচিত। যে একবার নিজেকে কোন পীরের হাতে বিক্রয় করিবে, সে পুনরায় অন্য পীরের নিকট তাঁহার জীবৎকালে আর বিক্রীত হইতে পারে না, অন্ততঃপক্ষে হওয়া উচিৎ নহে। কোন কারনবশতঃ যদি পীরের প্রতি ভক্তির অভাব হয়, তবে বায়াত ছুটিয়া যায়। সুতরাং বায়াত হইবার পূর্ব্বে ভালরূপ পরীক্ষা করা উচিত যে তিনি বায়াত লইবার উপযুক্ত কি না। একবার দাসত্ব করিলে জীবৎকাল সে দাসত্বে সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যক। পীরের উপর পূর্ণ এতেকাদ্্ থাকিলে খোদার তরফ হইতে মুরীদের উপর ফয়েজ পৌঁছাইতে থাকে। পীর হইতে মুরীদ কোন ক্ষেত্রে অধিকতর উপযুক্ত হইতে পারে, কিন্তু মুরীদকে পীরের প্রতি অটল ভক্তি রাখা আবশ্যক, অন্যথা বায়াত বাতিল হয়। পীর হইতে ফয়েজ পৌঁছাইতে থাকিলে, কখন অন্যত্র মুরীদ হওয়া উচিত নহে-পীর জীবিত থাকুন বা নাই থাকুন। পীরের মৃত্যু হইলে মুরীদ অন্যত্র বায়াত হইতে পারে, যদি ফয়েজ হইতে মাহরুম থাকে।
রুহ দেহের মধ্যে কয়েদীর ন্যায় থাকে। দেহ পরিত্যক্ত হইলে রুহের প্রসার বর্দ্ধিত হয়। মুক্ত রুহ হইতে মানুষ অদিকতর ফয়েজ লাভ করিতে পারে। সুতরাং মুরীদকে মনে করা উচিত নহে যে, পীরের মৃত্যুর পর মুরীদের উপর ফয়েজের দ্বার বন্ধ হইবে, বরং উক্ত দ্বার প্রশস্ত হইবে ও অধিকতর ফয়েজ হাছেল হইতে থাকিবে। সকই নির্ভর করে পীরের যোগ্যতার উপর। যিনি খোদার যতই নিকটতর, তিনি ততই ফয়েজ পৌঁছাইতে সক্ষম।
প্রকৃতপক্ষে পীর নিমিত্ত-মাত্র। সকল ফয়েজের মূল খোদা। পীর অছিলামাত্র। পীর কেবল ঐশ ভাÐারের সুইচ্্ (চাবিটি) খুলিয়া দেন, যেন মুরীদ খোদার দরবার হইতে নেয়ামত পাইতে পারে।
অলি-আল্লাহ বলিতে বুঝায় খোদার পেয়ারা। যিনি যতই খোদার ভক্ত হন, খোদা ততই তাঁহার প্রতি রত থাকেন। সময়ে সময়ে আশেক মাশুক হন, আর মাশুক আশেক হন। পীর যতই খোদার এশ্্কে ডুবিয়া যান, ততই খোদার কোরবত হাছেল হয়। আর যতই খোদার কোরবত (নৈকট্য) হাছেল হয়, ততই খোদার অনুগ্রহ বর্ষিত হইতে থাকে। যে পীর যতই খোদার নিকটতর, সেই পীর হইতে খোদার ফয়েজ ততই বেশী মুরীদের উপর পৌঁছে।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) (১৯৯৩), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ২১-২৩।
দীক্ষার বৈশিষ্ট্য হইতেছে তছদিক। যে দীক্ষার ফলে তছদিক বা উপলব্ধি নাই, সে দীক্ষা অনুপাদেয়। বায়াতের উদ্দেশ্য সংযোগ-সাধন। মহাশক্তির সহিত সংগোগ করিয়া দেওয়াই বায়াতের উদ্দেশ্য।
পরমাত্মা ও জীবাত্মার মধ্যে একই ঐশ শক্তির সংযোগ আছে। বৈদ্যুতিক মোটরের সহিত শহরের প্রত্যেক বাড়ীর সংযোগ আছেতার যোগে। বাড়ীর সুইচটি টানিয়া মোটরের সহিত সংযোগ করিয়া দিলে সারা বাড়ী আলোকিত হয়। সেইরূপ জীবাত্মার মধ্যে আত্মিক বিদ্যুৎ বিদ্যমান। এই বিদ্যুতের সহিত পরমাত্মার সংযোগ আছে। জীবের পরমাত্মার সংযোগ সাধনই মুর্শিদের কার্য্য। যখন ঐ সংযোগ সাধিত হয়, তখন মুরীদ ঐশ আলামত দেখিত থাকে, মুর্শিদের মধ্যবর্ত্তিতায় মুরীদ খোদায়ী তত্তে¡র অনুসন্ধান লাভ করে, স্বপ্নযোগে বেহেশতী নেয়ামত উপভোগ করে, মহাসত্যের নিদর্শন পায়, জীবন ধন্য হয়। কিন্তু কতজনের ভাগ্যে এই উপলব্ধি হয়? মোছলেম হইয়া যদি সত্যের ৎবধষরংধঃরড়হ না হয়, যদি খোদার নৈকট্য মাহছুছ না করা যায়, তবে জীবনই বৃথা। জীবনকে সার্থক করিবার জন্যই মুর্শিদের মধ্যবর্ত্তিতার আবশ্যকতা।
মুর্শিদের সাহায্যে যদি উপলব্ধি সাধিত হয়, তবে মনে নূতন বলের সঞ্চার হয়, সর্ব্বত্র খোদার বিদ্যমানতা অনুভুত হয়, নামাজে অলি-আল্লাহর সাড়া পাওয়া যায়, ফেরেশতার মদদ মিলে, অন্তর্চক্ষু খুলিয়া যায়, নির্ম্মল শক্তির অধিকারী হওয়া যায়। আর যদি বায়াতের দ্বারা দিব্যশক্তি লাভ না হয়, দুন্্ইয়ার বুকে বেহেশতের সাড়া না পাওয়া যায়, তবে মুরীদের দুঃখের সীমা থাকে না, বায়াত ফলপ্রসূ হয় না, মুর্শিদ মুরীদের দেলকে অধিকার করিতে পারে না। যে মুরীদ অলি-আল্লাহর দীদার লাভ করিয়াছে, খোদার তাজল্লী বাহ্যিক চক্ষে দেখিয়াছে, পীরের দোয়ায় কঠিন ব্যাধি হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে, সে পীরের পদ-রেণু চুমিতে চায়, বুকের মধ্যেই তাঁহার স্মুতিকে ভক্তিভরে পোষণ করে, তাঁহারই চরণে নিজেকে উৎসর্গ করে, পীরকে ঐশ-রহস্যের উদ্্ঘাটন বোধ করে এবং দুন্্ইয়ার মধ্যে সর্ব্বোপরি ভক্তি-ভাজন মনে করে।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) (১৯৯৩), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ২৮।
পীর-মুরীদের ছেলছেলা কত পবিত্র, কত গুরুত্বপূর্ণ। এই পবিত্র সম্বন্ধ বর্ত্তমানযুগে রছমে পরিণত হইয়াছে। আফ্ছোছ, অর্থই হইয়াছে মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। অর্থ হইতেছে পার্থিব বস্তু, আর প্রেম হইতেছে অপার্থিব বস্তু। দুইটির মধ্যে আছমান ও জমিন পার্থক্য। যেখানে অর্থের অধিকার, যেখানে প্রেমের অধিকার নাই। খোদার আশ্রয় লইলে অর্থকে পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে অর্থের আকাঙ্খা প্রবলতর, সেখানে খোদার আকাঙ্খা লঘুতর, যে হৃদয়ে গায়ের খোদার পূজা, সে হৃদয় খোদার গ্রহণীয় নহে। খোদা কাহারও সহিত শরীক হইতে চান না। মোহায়েদ সেইযে খোদাতে পূর্ণ অন্তঃকরণটি সপিয়াছে, যাহার আকাঙ্খা একমাত্র খোদা।
একই সময় মানুষ দুই বস্তুর আশেক হইতে পারে না। প্রেমিক প্রেমময়ের আশেকঅর্থের আশেক নহে। যিনি প্রেমকে এখতেয়ার করিয়াছেন, তিনি ধন্য হইয়াছেন। প্রেমই সত্য, প্রেমই পাক, ইহা স্পর্শমণি, ইহার সংস্পর্শে অলি-আল্লাহ মিলে, রাছুল মিলে, খোদা মিলে। খোদা প্রেমকে জগতে দিয়াছেন এই হেতু যে এন্্ছান ইহারই সাহায্যে খোদাতক্্ পৌঁছাইতে পারে। খোদা তাঁহার হাবিবকে দুনিয়ার বুকে পাঠাইয়াছিলেন এই হেতু যে, তিনি ইনছানকে ঐ তরতীব শিক্ষা দিবেন, যে তরতীব দ্বারা সে প্রেম হাছিল করিতে পারে ও প্রেমের সাহায্যে প্রেমময়ের সান্নিধ্য লাভ করিতে পারে।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) (১৯৯৩), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন; (১৯৯৩) পৃ: ২৫।
আল্লাহ্্ পাকের অতি প্রিয় সৃষ্টি মানব জাতির হিদায়াতকল্পে যুগে যুগে বহু নবী রসূল ধরায় প্রেরিত হয়েছেন। আখেরী নবী হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরবর্তী যুগে আর কোন নবী প্রেরিত হবেন না, বিধায় বিভ্রান্ত মানবগোষ্ঠীর হিদায়াতকল্পে আল্লাহপাকের কতিপয় মনোনীত আত্মা ধরায় প্রেরিত হয়। তাঁরা আখেরী নবীর মতবাদ এবং কার্যধারা মানুষের মধ্যে প্রচার করা থাকেন। নবুয়তের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বটে, কিন্তু নবুয়তের কার্যধারা বেলায়েতপ্রাপ্ত আলী আল্লাহগণের মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
ক্ষেত্রবিশেষে একজনকে অপরজনের উপর প্রাধান্য দান করা হয়েছে। যেমন গাউছুল আজম, গাউছে জামান, মোজাদ্দেদ, আরেফ বিল্লাহ প্রমুখ। হযরত খানবাহাদুর আহ্্ছানউল্লা (র:) তন্মধ্যে অন্যতম। তাঁর স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ এবং জীবনের কার্যধারা নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ধারা অনুপাতিক। এহেন আল্লাহ মনোনীত আত্মাগণের দ্বারা বিশে^ তরিকার উদ্ভব হয়েছে। প্রত্যেক হক্কানী তরিকার উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহপ্রাপ্তি। যে সমস্ত হক্কানী তরিকায় রাসূলে পাক প্রবর্তিত শরীয়তে পরিপূর্ণতা বিদ্যমান এবং শরীয়তের মাধ্যমে তরিকতের শিক্ষা রয়েছে ঐ সমস্ত তরীকাই গ্রহণযোগ্য এবং অনুসরণীয়।
কাদেরীয়া, চিশতীয়া, নকশবন্দীয়া, মোজাদ্দেদীয়া এবং ওয়ারেছীয়া তরিকাসমূহের সাসংক্ষেপ আহ্্ছানিয়া তরিকা।
বর্তমান কর্মব্যস্ত বিশে^ শরীয়তের মাধ্যমে তরিকতের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দান এই তরিকার বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেছেন, “শরীয়ত আমার শরীর, আর তরিকত আমার প্রাণ, এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্য বিশ^কে জানাইতে আমি উদগ্রীব”। তাঁর এই বাণী তাঁর জীবনের কার্যধারায় পরিস্ফূট। তাঁর তরিকার পদ্ধতি বিশ^মানব কল্যাণমুখী সমাজে সংক্ষেপ বিধায় ইহা প্রসার লাভ করেছে। তিনি আখেরী যুগের মোজাদ্দেদ বলে বিশিষ্ট ওলামাগণ কর্তৃক আখ্যায়িত। তৎরচিত পুস্তকাবলী এবং তৎপ্রতিষ্ঠিত আহ্ছানিয়া মিশন এই কথার প্রমাণ করে।
যে কোন তরিকা কোন না কোন ওলী আল্লাহর নামে খ্যাত। এ তরীকা যাঁর নামের মাহাত্ম্য বহন করে তিনি হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা, এম.এম., আর.এস.এ., আই.ই.এস। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের শিক্ষা বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর।
খুলনা বিভাগের (তৎকালীন খুলনা জেলার) অন্তর্গত (বর্তমান) সাতক্ষীরা জেলাধীন কালিগঞ্জ থানার নলতা গ্রামে ১৮৭৩ কৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের কোন এক শনিবারে অতি প্রত্যুষে এক সম্ভ্রান্ত এবং সম্পন্ন পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জনাব হজরত মুন্সী মফিজ উদ্দীন (র:) এবং পিতামহ জনাব হযরত মুনশী মুহম্মদ দানেশ (র:) অত্যন্ত ধার্মিক এবং ন্যায়পরায়ণ লোক ছিলেন। তাঁর পিতামহ দরবেশ কাশেম সাহেবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং তাঁর পিতা হযরত মাওলানা সূফী মুহম্মদ আলী (র:) যিনি যশোহরে ইরানী শাহ নামে পরিচিত তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করে আধ্যত্মিক সাধনা করতেন।
তাঁর জন্মের প্রাক্কালে এই ইরান দেশীয় দরবেশ গ্রীন বোটযোগে আগমন করেন এবং এ নবজাত শিশুর আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি আশৈশব নীরব চিন্তাশীল এবং উদার নীতিবান ছিলেন, ফলে উচ্চতম শিক্ষার অগ্রগতির সাথে সাথে তাঁর মধ্যে গড়ে উঠে কর্তব্যপরায়ণতা, সময়নিষ্ঠতা, ইসলাম ধর্ম প্রবণতা, আকিদা, আখলাখ, সদাচরণ, প্রেম, প্রীত, অহিংস্, সাম্যবাদিতা এবং বিশ^ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদি। এতে সহজেই অনুমেয় যে আল্লহ্্ পাকের গোপন হস্ত তাঁর প্রতি প্রসারিত ছিল।
তাঁর বায়আত গ্রহণও অলৌকিক মহিমাময়। কোন এক শুভলগ্নে পাটনা নিবাসী জনাব সৈয়দ হাবিব আহমদ (র:) যিনি গফুর মাহ হুছছামী নামে পরিচিত, হয়রত হাফেজ হাজী সৈয়দ ওয়ারেছ আলী শাহ (র:) -এর নির্দেশক্রমে চট্টগ্রাম আগমন করেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে জনাব হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) -এর সাথে সাক্ষাত করেন। ইতিপূর্বে তিনি উপরোক্ত বুযুর্গের সাথে পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু হযরত গফুর শাহ্্ (র:) -এর সাথে আলাপ-আলোচনায় মুগ্ধ হলেন এবং বুঝতে পারলেন আল্লাহ্্ পাকের ইঙ্গিতেই এই সংসারমোহমুক্ত আল্লাহ্্-প্রেমিক ওলী-আল্লাহর আগমন। তিনি সস্ত্রীক তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করে আল্লাহ্ তায়ালার সাথে প্রেম পয়দা হওয়ার নব প্রেরণা লাভ করেন। তাঁর অন্তরে নবপ্রেমোচ্ছ¡াস সঞ্চারিত হয় এবং অন্তর আঁখিতে অনেক অনৈসর্গিক নূর উদ্ভাসিত হয়।
হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) রসমী (প্রথাগত) পীরের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কেহ তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করতে চাইলে তিনি নিজ অযোগ্যতা প্রকাশ করতেন এবং অপর পীর-বুযুর্গের শরণাপন্ন হতে উপদেশ দান করিতেন। যারা নাছোড়বান্দা হয়ে কোনক্রমেই সঙ্গ ত্যাগ করতেন না, তাদেরকে নিঃস্বার্থ অনাড়ম্বর দীক্ষাদানে মুস্তাফিজ করতেন। তিনি ছিলেন আশেক; পীর-আশেক পীরজগতে অতি বিরল। পীরের খলিফা হয় কিন্তু প্রেমিকের খলিফা হওয়া অনিশ্চিত, যেহেতু আহ্্ছানিয়া তরিকা জাঁ-নশীনী, সাজ্জাদা-নশীনী বিবর্জিত, তিনি বলতেন ইশকের ক্ষেত্রে খিলাফতি অর্থহীন। ইশক আল্লাহ্্ তায়ালার খাস রাজ। যার ভাগ্য সুপ্রসন্ন সে ইহার স্বাদ প্রাপ্তে মালামাল হয়ে যায়। তরীকাসমূহের মূলে আল্লাহ্্প্রাপ্তি। মহব্বতই একমাত্র আল্লাহ্্প্রাপ্তির প্রধান সম্পদ। এতে আল্লাহ্্ ও বান্দার নিগূঢ় রহস্য বিদ্যমান। মহব্বত এ তরীকার প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং নিঃস্বার্থে সকল সৃষ্টির সেবা করা অন্যতম প্রধান বিষয়। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হেতু তিনি কোন খলিফা মনোনয়ন না করে আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন।
সূত্রঃ ডা: কাজী আবদুল মোন্য়েম, ইসলামের আলোকে সূফীবাদ ও সাধনা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৮০); পৃঃ ৮৯-৯১।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) প্রনীত আমার জীবনধারা, থেকে উদ্বৃত।
“একদা বশারাত হইল ৪০০ শত মানবের রূহানী চিকিৎসার জন্য আমাকে দেশে ফিরিতে হইবে। আমার মত এই নালায়েকের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হইল, তাহা মাথায় লইয়া দেশে ফিরিলাম এবং সংকল্প করিলাম জীবনের অবশিষ্ট কয়েক দিন গরীব-সেবায় ব্রতী থাকিব। কলিকাতা শহরের কৃত্রিম আকর্ষণ আমার মিটিয়া গিয়াছে। এখন অনাড়ম্বর ও দীনভাবে জনসাধারণের খেদমত করাই জীবনের একমাত্র কাম্য স্থির করিলাম।
দেশের উপযুক্ত অবস্থানের স্থান ছিল না, এযাবৎ আবশ্যকতাও অনুভব করি নাই। এখন আশ্রয় লইবার জন্য একটী বসতিঘরের অভাব বোধ করিলাম এবং উক্ত অভাব দূরীকরণার্থ ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলাম।
বাড়ীর সংলগ্ন একটী মছজিদ আছে, উহাই আমার কর্ম্মস্থল হইল। একদিন মধ্যাহ্নে মিঞা অহেদ বখশ অতি বিনীতভাবে আমার নিকট আন্তরিক শ্রদ্ধা প্রকাশ করিল। আমি তাহার বিচলিত ভাব দেখিয়া অবাক হইলাম। পরে জানিলাম তাহার উপর কিছু ইঙ্গিত হইয়াছে, ক্রমে মিয়া মজনুর রহমান, আবদুর রহমান, মিঞা পরাণ আলীও আমার নিকট আসিল মানসিক ব্যাকুলতা প্রকাশ করিল। তাহাদের স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনিলাম, একটু স্তম্ভিত হইলাম। যাহা হউক, তাহাদিগের সহিত ক্রমে ঘনিষ্ঠতা ঘনীভূত হইল ও তাহাদিগের প্রতি কিছু কিছু উপদেশ দেওয়া হইল। ক্রমে আরও লোক উপস্থিত হইতে থাকিল, নিষেধ সত্তে¡ও কেহ কেহ বারংবার হাজেরী দিতে লাগিল। বয়োবৃদ্ধ যঁহারা আছেন, তাঁহারা তাহাদিগকে কত উপহাস করিতেন। কেহ বা তাহাদিগকে অন্যত্র প্রলুব্ধ করিবার চেষ্টা করিলেন। স্বপ্নে কাহারও সন্দেহ নিরাকৃত হইল। এখানে টাকা পয়সার ব্যবসা ছিল না, সুতরাং ক্রমে আগন্তুকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকিল। আমার অযোগ্যতা জ্ঞাপন সত্তে¡ও কেহই নিরস্ত হইল না। সংখ্যা বাড়িতে থাকিল।” পৃঃ ১১১-১১২
১.১.১৯৩৪ তারিখে লেখা মুর্শিদ মওলা খানবাহাদুর আহ্্ছানউল্লা (র:) এর পত্র
(ভক্তের পত্র, পত্র সংখ্যা ১৪৮)
তোমরা পরমানন্দ লাভ কর, সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে অচল অটল থাকিতে পার, নামাজে স্বর্গীয় আনন্দ ভোগ করিতে পার, স্বপ্নরাজ্যে এই দুন্্ইয়া অতিক্রম করিয়া পরলোকের শান্তির আস্বাদ পাইতে পার, ইহাই আমার অন্তরের ইচ্ছা। তোমাদিগের গৃহখানি আনন্দ-নিকেতনে পরিনত হয়, তোমাদের দৃষ্টান্ত দেখিয়া অপরে মানুষ হইতে পারে, জীবনকে গঠন করিতে পারে, খোদা রছুলকে চিনিতে পারে, সংসারের ঝঞ্ঝার মধ্যে প্রকৃত সুখের আস্বাদ পাইতে পারে, এখান হইতেই বেহেশ্্তী সাজিতে পারে, ইহাই আমার প্রাণের আশা। নামাজে দাঁড়াইয়া মহাপ্রভুর সহিত মনের ভাব আদান-প্রদান করিবে, অতীত কথা মনে করিয়া খুব রোদন করিবে, ক্ষমা ভিক্ষা করিবে, নিজের ক্ষুদ্রত্ব জ্ঞাপন করিবে, আপনাকে তাঁহারই হাতে সমর্পণ করিবে; তবেই তাঁহার দয়ার পরিচয় পাইবে। জুমার রাত্রে শরীর ও মনকে বেশ পাক্্ করিয়া একাকী ঘরের কোণে নির্জ্জনে একটু অন্ধকারের মধ্যে মছলা বিছাইয়া সারা মনটি দিয়া নামাজ ধীরে ধীরে পড়; আর মনে কর যে, খোদার সম্মুখে আছ, তিনি তোমার মনের সমস্ত খবর বুঝিতে পারিতেছেন, আর তোমাদিগকে কৃপা করিবার জন্য প্রস্তুত আছেন। যে পর্য্যন্ত মন ভরিয়া না যায়, সে পর্য্যন্ত ছেজদা হইতে মাথা তুলিবে না এবং খোদার কাছে মিনতি বরিবে, যেন নিরাশ হইয়া তাঁহার দরবার হইতে ফিরিতে না হয়। শয়নকালে হাত উঠাইয়া অতি বিনীতভাবে সিক্ত চক্ষে খোদার নিকট আরজু করিবে যেন রাতটী ভাল ভাবে কাটে, কিছু না কিছু অনুগ্রহ বর্ষিত হয়, নামাজের জন্য বেশ আকর্ষণ জন্মে, খোদা রছুলের উপর মহব্বত হয়, দুন্্ইয়ার মধ্যে কিছু না কিছু আলামত নজর আসে, নতুন হেম্মত পয়দা হয়। দরুদ শরীফ পড়িতে পড়িতে শুইয়া যাইবে যে পর্য্যন্ত ঘুম না আসে এবং খোদা ছেওয়া যেন অন্য কোন চিন্তা মনে না জাগে, তবেই ইন্্শা আল্লাহ্্ কিছু না কিছু বুঝিতে পারিবে। সংসারের সব কাজ করিতে থাকে, তারই মধ্যে সর্ব্বদা খোদাকে ইয়াদ করিবে, তাহা হইলে মন সর্ব্বদা প্রসন্ন থাকিবে, আর খুব পাক্্-ছাফ থাকিতে চেষ্ট করিবে।
পিতামাতা ও বয়োজ্যেষ্টের আজ্ঞা পালন করিতে দ্বিধা বোধ করিবে না। তাঁহাদিগের অন্তর শীতল হইলে, আল্লাহ্তা’লার খাছ দোওয়া তোমার উপর বর্ষিত হইবে। তাই বলি, নিজের কাজের সহিত সংসারের কাজও পুরাদমে আদায় করিবে ও সকলকে এই নীতি অনুসরণ করিতে বলিবে। পিতামাতাকে ছাড়িয়া কেহ খোদাতা’লাকে পাইতে পারে না।
আঁ-হজরত (দ:) প্রেমিক-প্রবর হজরত আলী (রা:)কে মারেফতের তরতীব খাছভাবে শিক্ষা দিয়াছিলেন এবং হজরত আলী (র:) হইতে ছেলছেলাক্রমে হজরত পীরাণপীর এবং হজরত পীরাণপীর হইতে পীর মুর্শিদতক্্ শিক্ষা জারী হইয়াছে। তাঁহা হইতে আঁ-হজরত (দ:) তক্্ এবং তাঁহা হইতে খোদা তক্্ পৌছান যায়। ইহার অর্থ এই নয় যে, সারা জীবনটী ধরিয়া এই ক্রম অতিক্রম করিতে হয়, বরং প্রেমিক যুগপৎ প্রেমময়তক্্ পৌঁছাইতে পারে আঁ-হজরতের মধ্যবর্ত্তিতায়।
প্রেম একচী সেতু স্বরূপ, যাহার একপ্রান্তে প্রেমময় ও অপর প্রান্তে প্রেমিক। প্রেম-রজ্জু দৃঢ়রূপে পাকড়াও করিলে পীরের সাহায্যে আঁ-হজরত ও আঁ-হজরত (দ:) এর সাহায্যে খোদাতক্্ পৌঁছাইতে পারে, কিন্তু সকলের মূলে চাই নিষ্কলুষ প্রেম!
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ২৫-২৬।
(মুর্শিদ মওলা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) এর ব্যাখ্যা)
আমি কোনো রছমের বাধ্য নহি। আমি জানিকত নালায়েক আমি, তাই মুর্শিদ সাজিবার সাধ আমার নাই। বায়াতের জন্য আছেন মাওলানা ছাহেবান, তাঁহারাই এই গুরু দায়িত্ব বহন করুন আর জবাবদিহি করুন। আমি গরীব, ধন বা যশের লিপ্সা আমার নাই। চিরদিন শিক্ষকতা করিয়া আসিয়াছি, এখনো যদি কেহ কোন উপদেশ চান, তাহা নিঃস্বার্থে দিতে প্রস্তুত আছি। যদি তাহাতে কাহারো উপকার সধিত হয়, তবে খোদার দরগাহে শোকরিয়া আদায় করিব। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আমি বলিতে চাই যে যদি কেহ বায়াত লইতে চায়, তবে অনায়াসে বিনা আপত্তিতে মুনশী, মৌলবী বা মাওলানাদিগের নিকট উপস্থিত হইতে পারেন। পাছে কোন মুর্শিদের মনে হিংসা জন্মে, সেই ভয়ে আমি কাহারো রুজির অন্তরায় হইতে চাই না, যে কেহ তাঁহাদের স্মরণাপন্ন হইতে পারে। আমার দায়িত্ব যত লঘু হয়, আমি তাহারই তত পক্ষপাতী। খোদা আমাকে অপরের হিংসা বা দ্বেষ হইতে মাহ্্ফুজ রাখুন, এই প্রার্থনা, আমীন!
বর্ত্তমান যুগে বহু প্রচারক দৃষ্টিগোচর হয়, যাঁহারা দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়াই ক্ষান্ত। বক্তৃতা দ্বারা কতদূর ফয়েজ পৌঁছিতেছে, তাহা চিন্তা করিবার অবসর তাঁহাদের নাই। তাঁহাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হইলেই তাঁহারা সন্তুষ্ট, অপরের চিন্তার সময় তাঁহাদের কোথায় ?
মানুষ চায় দৃষ্টান্তমানুষ চায় আদর্শ। বক্তৃতার দ্বারা মানুষ তৈয়ারী হয় না। আঁ-হজরত (দ:) স্বীয় জীবনের আদর্শ দ্বারা শিক্ষা দিয়াছিলেনধৈর্য্য, সরলতা, ক্ষমাশীলতা, দয়ালুতা, অনাড়ম্বতা, সমতা, চরিত্র। কখনো কৃষক বেশে, কখনো সওদাগর বেশে, কখনো গৃহীর বেশে, কখনো সৈনিক বেশে, কখনো বা রাজরাজেশ^র বেশে সময়োচিত শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি ছিলেন কর্ম্মী পুরুষ। কার্য্য দ্বারা সবাইকে শিক্ষা দিয়াছিলেন। তাঁহারই আদর্শ আমাদের অনুকরণীয়। সারা বিশ^ তাঁহারই কার্য্য-প্রণালী অনুসরণ করিয়া আজ সভ্যতার দাবী করিতেছে। আর আমরা কর্ম্মকে ত্যাগ করিয়া বাকবিতÐা দ্বারা বৃথা চেষ্টা করিমানুষকে জয় করিতে, তাহাদের সর্ব্বস্ব করগত করিতে, স্বীয় নফ্্ছকে পুষ্ট করিতে। স্বীয় স্বার্থকে আমরা বড় দেখি।
আমরা নিজে যাহা করি না, অপরকে তাহাই বলি, সুতরাং আমাদের কথার কোন আছর হয় না। বাক্যের দ্বারা খেদমত হয় নাকার্য্যরে দ্বারাই হয়।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন(১৯৯৩); পৃ: ১৮-১৯।
পীরের খলিফা সম্পর্কে হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) এর উক্তিঃ
হজরত আকদাছ ফরমাইয়াছেন: নায়েবে আশেক অর্থহীন। পীরের ছেল-ছেলা আছেএকের পর এক গদী-নশীন হয়, কিন্তু আশেকের পক্ষে কোনো নিয়মানুবর্ত্তিতা নাই। খোদার আশেক কখন কে হন, কেহ তাহা নির্দ্দেশ করিতে পারে না। আশেক-মাশুকের কেচ্ছা স্বতন্ত্র। শতাব্দী পর আবদালের আগমন হয়। খোদার রহম কখন কাহার উপর অবতীর্ণ হয়, কেহ বলিতে পারে না; পীরজাদা পীর হইতে পারেন কিন্তু আশেকজাদা আশেক না হইতেও পারে। কেবল পরিশ্রম দ্বারা এশ্্ক লাভ হয় না। খোদার অনুগ্রহের উপর ইহা নির্ভর করে। কোনো আলেম, পীর বা মাওলানা ইচ্ছাপূর্ব্বক কাহাকেও আশেক বানাইতে পারেন না। ইশ্্ক খোদাদাদ বস্তু, ইহা অপার্থিব।
এই হেতু আমার হুজুর আকদাছ, যিনি মাদার-জাত আশেক ছিলেন, কাহাকেও খলিফা বানান নাই। তাঁহার উক্তি ছিলএশ্কের ব্যাপারে খেলাফত নাই, আশেকের খলিফা হয় না যেমন পীরের খলিফা হয়।
নিজের যোগ্যতা না থাকিলে অপরের নির্দ্দেশে খলিফা হওয়া কাম্য বস্তু নহে। বর্ত্তমান কালের প্রথা এই যে, মুরীদানকে আহবান করিয়া তাহাদের সম্মুখে পীর ছাহেব স্বীয় ছাহেবজাদা বা অপর কাহারও মস্তকে পাগড়ী বাঁধিয়া দেন, তৎপর সকলেই তাঁহাকে খলিফা বলিয়া সংবর্ধনা করে।
আমি স্বয়ং এই রছমের পক্ষপাতী নাই। খলিফা সর্ব্বসাধারণের মনঃপুত না হইলে উক্ত পদে বরিত হওয়া উচিত নহে। যতক্ষণ এন্্ছান খোদার রাহে রাহী হইবার উপযোগিতা লাভ না করেন, ততক্ষণ তাঁহার খেলাফতের দাবী করা অসঙ্গত। খলিফা হইলেন খোদার প্রতিনিধি, সুতরাং তাহার দায়িত্ব কত অধিক। যিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে অশক্ত তাঁহার মাথায় খেলাফতের পাগড়ী অর্পণ করা বিবেক-বিরুদ্ধ এবং অর্থহীন।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ২১।
মুরীদের আত্মিক উন্নতি দেখিলে মুর্শিদ খোদার দরগাহে শোকরিয়া আদায় করেন, ভক্তকে বক্ষের উপর স্থান দেন ও ভক্তের ভক্ত হইয়া পড়েন। তখন সব শ্লাঘা, সব গরিমা দূরে চলিয়া যায়, আশেক মাশুকের স্থান আর মাশুক আশেকের স্থান গ্রহণ করে, সকল পার্থক্যের অবসান হন, অনুভূতি উভয়কে জয় কনে, মহাসত্য প্রকাশ্যমান হয়।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:), আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৯৩); পৃ: ১৮।
হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) আল্লাহ্্প্রাপ্তির সকল তরীকার প্রতি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তরীকতের সালিকিনগণের জন্য স্বীয় পীর যে সমস্ত আমল এবং রিয়াযতের পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন উহা পূর্ণ ভক্তির সাথে আমল করতে উপদেশ দিতেন।
সৃষ্টের সেবা এবং ¯্রষ্টার ইবাদত-এর উদ্দেশ্যে সর্বজনীন আহ্ছানিয়া মিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। যে কোন তরীকার লোক এ প্রতিষ্ঠানে সদস্যভূক্ত হতে পারে। আহ্ছানিয়া তরীকা এবং আহ্্ছানিয়া মিশনের সভ্যগণের প্রতিপাল্য মূলনীতি নিন্মে উদ্বৃত হলঃ
অল্প আহার করবে, কম কথা বলবে ও কম নিদ্রা যাবে। কাউকেই হেয়জ্ঞান করবে না। কারও গীবত করবে না এবং কারও অন্তরের ব্যথা দেবে না। সত্য বলবে, সততা অবলম্বন করবে। শত্রæকে মিত্রতা দ্বারা বশীভূত করবে। রোগে-শোগে সকল অবস্থায় ধৈর্যধারণ করবে। ¯্রষ্টার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তি ও মহব্বত রাখবে। স্বীয় ইচ্ছাকে বিলিয়ে দিয়ে ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাতে বিলীন হবে। (আহ্ছানিয়া মিশন মত ও পথ)
এভাবেই আল্লাহর দীদারলাভে এক এক কালে এক একজন, মহাজ্ঞানী আত্মবিদগণ অমূল্য বাণী দ্বারা কামালিয়াত হাসিল করেছেন এবং বিভ্রান্ত মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে আল্লাহর মদদ পেয়েছেন। আশরাফুল মখরুকাতের জন্য চরম এবং গরম ত্যাগ স্বীকার করতে তাঁরা কখনো কার্পণ্য করেননি, বরং সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষকে তাঁদের প্রদর্শিত সর্বোপরি আল্লাহ ও রসূলের আদর্শ অনুসরণে কামিয়াব হতে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন। এ কামিল পীর-দরবেশ কখনো অভিভাবক হিসেবে, কখনো একান্ত বন্ধু হিসেবে, আবার কখনো একান্ত আপনজন হিসেবে মানুষের খেদমতে নিয়েজিত ছিলেন। যার ফলে আল্লাহর আদেশ আর প্রিয় নবী (সা:)-এর নির্দেশ গ্রহণ করতে সর্বস্তরের সাধারণ-অসাধারণ মানুষ দ্বিধা করেনি। বরং বলতে গেলে যুগে যুগে কালে-কালে পৃথিবীর জনসাধারণ তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহর দিদার পেয়েছেন। এখানেই পবিত্র কালামুল্লাহর প্রদর্শিত পথের সার্থকতা, ঠিক তেমনি পূতপবিত্র কালামুল্লাহর বাণী বহন করে যাঁরা আল্লাহ রসূল (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথে অনুসারীদের চলার প্রেরণা দিয়েছেন তাঁরা সঠিক সার্থকতার দাবীদার। আল্লাহর দিদার তাঁদের জন্য পবিত্র আমানত স্বরূপ। এরই মাধ্যমে সৃষ্টির সাথে ¯্রষ্টার সংযোগ করা সহজতর। তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত অনুযায়ী তাঁরা সব সময় স্মরণীয় ও বরণীয়।
তথ সূত্রঃ ডা: কাজী আবদুল মোন্য়েম, ইসলামের আলোকে সূফীবাদ ও সাধনা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (১৯৮০); পৃঃ ৯২।
হাম্্দ্্ হ্যায় ছব জাতে পাকে কিব্রিয়াকে ওয়াস্তে-ইয়া এলাহী শাফীয়ে রোজে-জাজাকে ওয়াস্তে-শেরে হক হজরত আলী মুরতুজাকে ওয়াস্তে-হজরত আবেদ জানাবে বাকের অ আহলে- ছাফা- হজরতে মা’রুফে র্ক্খুী আওর ছিররে ছক্তী আলী- মেরে আরমানে দিলীকো জল্্দ্্ পুরা র্ক্ খোদা-আওর জনাব বুল- ফারাহ্্, আওর বুল-হাছান, আওর বু-ছাইদ আওর জনাব আবদুর রাজ্জাক, আওর মোহাম্মদ জিশয়ুর- হজরতে ছৈয়দ আলী ও শেখ মুছা হক পরাস্ত- শেখ আবুল-আব্বাছ আওর ছৈয়দ বাহাউদ্দীন মস্ত- শাহেদীন হজরত জালাল আওর শেখ ফরীদে বাহকরী- শাহে ইব্রাহীম ও আমানউল্লা আওর শাহে হুছাইন- আবদুছ ছামাদ, আবদুর রাজ্জাক আওর ইছামাইল শাহ্্- শাহেদীন হজরত নাজাত উল্লাহ আওর খাদেম আলী- হজরত ওয়ারেছ আলী মাহবুবে রব্বে দো-জাহাঁ- কেবলায়ে-দীন ও পেশোওয়ায়ে আহলে একীন- হজরতে আহ্ছানউল্লা জো আওলিয়ায়ে ফি জামান আপনে এহ্্ছান অ-করম্ছে আরজু হামে মেটা- উন্্ বুজরগোকি বদৌলাত আরজু মেরে হো কবুল-আজিজ অ মিছকীন কো দ্বিদারছে¥াছরুর কর- আওর ছালাত ও ছালাম খতমুল আম্বিয়াকে ওয়াস্তে। রহমতে আলম-জানাবে মোস্তফাকে ওয়াস্তে। ছৈয়দ হজরত হাছান শাহে- হুদাকে ওয়াস্তে। জাফর অ মুছা কাজেম আওর রেজাকে ওয়াস্তে। আওর জোনায়েদ ও শিবলী শাহে- হুদাকে ওয়াস্তে। শাহ আবদুল ওয়াহিদে আহলে ছাফাকে ওয়াস্তে। গাউছুল-আজম পেশোয়ারে আউলিয়াকে ওয়াস্তে। ছৈয়দ আহমদ বা কামাল বা- ছাফাকে ওয়াস্তে। হজরতে ছৈয়দ হাছান হাজাত-রাওয়াকে ওয়াস্তে। হজরতে ছৈয়দ মোহাম্মদ হকনামাকে ওয়াস্তে। শাহ্্ ইব্রাহীম শেখে বা -খোদাকে ওয়াস্তে। হজরত শাহে হেদায়েত বা- ছাফাকে ওয়াস্তে। আওর জানাবে শাকীর উল্লা রাহনুমাকে ওয়াস্তে। দস্তেগীর ও রাহনুমায়ে পেশোয়াকে ওয়াস্তে। গাওছে দাওয়ান ইমামুল আইলিয়াকে ওয়াস্তে। হজরতে শেখ গফুর মোক্তদাকে ওয়াস্তে। গওছে দাওরান কুল হাজাত রাওয়াকে ওয়াস্তে। কুত্বুল্্ আকতাব আহছান বা- খোদাকে ওয়াস্তে। ইয়া এলাহী আপনি জাতে কিবরিয়াকে ওয়াস্তে। খাতেমা বিল্্- খায়ের হো কুল আউলিয়াকে ওয়াস্তে।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুফি-সাধক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক, দেশ বরেণ্য সমাজ সেবক, এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক খানবাহাদুর আহছ্নাউল্লা (রঃ) বাঙালি মুসলমানের অহংকার এবং তাঁর কালের আলোকিত মানুষ। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে মুসলমানদের যে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গির যে পশ্চাদপদতা, সাংস্কৃতিক যে অবক্ষয় তাকে নতুন জীবনদৃষ্টি ও বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
শিক্ষাজীবন সমাপনান্তে কর্মজীবনে প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে তিনি ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস এর অন্তর্ভুক্ত হন এবং ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগীয় সহকারি পরিচালকের পদে নিযুক্তি লাভ করেন। এ পদে বৃটিশ শাসনামলে উপমহাদেশের তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। উক্ত পদে অধিষ্ঠিতকালে তিনি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল ও যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেন।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) ছিলেন বাঙ্গালী জাতিসত্ত¡ার প্রবক্তা, মুক্তবুদ্ধি ও অসা¤প্রদায়িক চিন্তা চেতনার ধারক। পেছনে পড়ে থাকা মুসলিম সমাজকে স্বমহিমায় উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার জন্য বিবিধ মহতী কর্মে তিনি ব্রতী ছিলেন।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, টেলর হোস্টেল, রাজশাহীর ফুলার হোস্টেল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এক দশকেরও বেশিকাল তিনি এর সিনেট সদস্য ছিলেন।
১৯১১ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। সেকালের অন্যতম শক্তিধর লেখক হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) সমাজ ও দেশ, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম, জীবন কথা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ৭৯টি অতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ও বহুমূখী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী তাঁকে ১৯৬০ সালে সন্মানসূচক ফেলোশীপ প্রদান করে। সমাজসেবা ও সমাজ-সংস্কৃতিমূলক অবদানের জন্যে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ পুরষ্কার ১৪০৫ হিজরি (মরণোত্তর)’-এ ভূষিত হন।
শৈশব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আধ্যাত্ম-চিন্তা ও সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। শুধু আল্লাহর সাধনাই নয়, তাঁর সৃষ্ট জীবকে ভালবাসা, তাদের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়াতে মানব জীবনের পূর্ণত্ব - এই ছিল তাঁর জীবন-দর্শন। এই ভাবাদর্শের ভিত্তিতে ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’- এই মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আহ্ছানিয়া মিশন’। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন’, যার সামাজিক ও আত্মিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড আজ স্বদেশের গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃত।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) আপন উদ্যোগ ও কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুসলমান জীবন ও মানসে যে শ্রেয় চেতনা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাতে পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজে এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। এই বিরাট, বিপুল এবং প্রায় পুরো এক শতাব্দীকালের সূর্য¯œাত মহাপুরুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বারে বারে স্মরিত ও উচ্চারিত হবেন।
মানব-শ্রেষ্ঠ, অলি-শ্রেষ্ঠ, রছুল শ্রেষ্ঠ শাফিয়োল ওমাম হজরত আহম্মদে মোজতবা মোহাম্মদে মোস্তফা ছাল্লেল্লাহো আলায়হেছ ছালামের সুন্নত পালন আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাঁহার কওল ও ফেল অনুসরণ আমার প্রধান লক্ষ্য। তিনি মেষ-পালক স্বরূপ সাংসারিক জীবন আরম্ভ করেন, আর রাজাধিরাজের পদ অলঙ্কৃত করিয়া সারা বিশ^কে জয় করিয়াছিলেন। তাঁহারই হস্তে মহামহিমান্বিত রোমক সা¤্রাজ্য ও মহাগর্ব্বিত পারস্য-সা¤্রাজ্য ধুলাবলুষ্ঠিত হইয়াছিল এবং পৌত্তলিক আরবদেশ তওহীদ বাণী গ্রহণ করিয়া একেশ^রবাদের সাক্ষ্য দিয়াছিল। তাঁহারই প্রভাবে সারা জগৎ কুসংস্কার পরিত্যাগ করিয়া সত্যের আশ্রয়-গ্রহণ করিয়াছিল। তাঁহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া আজ মোছলেম সমাজ গৌরবান্বিত। তিনি ছিলেন সত্যের প্রতিমূর্ত্তি, ঐশী জ্ঞানের ভাÐার, ধৈর্য্য ও শান্তির প্র¯্রবণ। তাঁহার জীবনের প্রতিকার্য্য বিশ^-সৃষ্টির অনুকরণীয়। পৃথিবীর বুক হইতে সারা কালিমা, সারা কলুষ অন্তর্হিত করিয়া শান্তির পবিত্র আলোক বিস্তার করাই এবং একতা ও সাম্যের বর্ত্তিকা লইয়া সারা ভুমÐলকে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ করাই ছিল তাঁহার জীবনের ব্রত। তাঁহারই দৃষ্টান্ত অবলম্বন করিয়া প্রত্যেক আত্মাকে প্রেম দ্বারা সঞ্জীবিত করা ও একতা, সমতা ও মৈত্রী বন্ধনে সকল আত্মাকে আবদ্ধ করত বিশ^-শান্তির সৃষ্টি করাই আমাদের একমাত্র কর্ত্তব্য।
আমার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য সকল শ্রেণীকে, ধর্ম্ম ও জাতি নির্ব্বিশেষে প্রেমষূত্রে আবদ্ধ করিয়া মহাপ্রভুর উদ্দেশ্য সাধন।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) আমার জীবনধারা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, পৃঃ ১৩০।
১। অমি বাল্যকাল হইতে নামাজ পড়িয়া আসিতেছি, যখন ইহার পূর্ণ স্বাদ পাই নাই, তখনও নামাজ হইতে অবসর লইতাম না, আমি দেখিতাম আমার বৃদ্ধ পিতা, কোনো কারণে নামাজ কাজা হইলে বালকের ন্যায় রোদন করিতেন, তাই আমিও নামাজ কাজা করিতে ভয় পাইতাম, নামাজ মানুষকে কি অমূল্য এনায়েত দান করিতে পারে, তাহা আমি অন্তিমকালে উপলব্ধি করিয়াছি। খোদাওয়ান্দ করিম প্রিয়তম নবীকে স্বীয় সমীপে আহŸান করতঃ গুপ্ত জ্ঞান দ্বারা মোস্তাফিজ করিয়াছিলেন এবং মে’রাজ শরীফ হইতে বিদায়কালে যে নামাজ তোফাস্বরূপ রাব্বুল আলামীন তাঁহার প্রিয়তম হাবীবকে তাঁহার পেয়ারা উম্মতের জন্য বখ্্শিশ করিয়াছিলেন, আমি সেই নামাজকে করুণাময়ের করুনার মহৎ দান বুঝিয়া কষ্ঠহার করিয়া রাখিয়াছি, তাঁহারই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য। এ যে মহাদান, যে দানের দ্বারা তুচ্ছ মানব সেই মহা পরাক্রমশালী রহমানুর রহিমের সহিত যোগাযোগ সাধন করিতে সমর্থ হয়।
২। আমি শেষ জীবনে সর্ব্বদা বা-অজু থাকি, এই ভয়ে যে যাহার স্মরণ প্রতি শ^াস-প্রশ^াসে রক্ষণীয়, বে-অজু থাকিলে পাছে সেই পরমারাধ্যের প্রতি অভক্তি প্রদর্শিত হয়।
৩। আমি জীবৎকালে দাড়িতে ক্ষৌর-সংযোগ করি নাই, এই খেয়ালে যে, ইহাতে আমার আকা, আমার প্রভু, যিনি আমার জীবনের আদর্শ, তাঁহার প্রতি আসম্মান করা হইবে।
৪। আমি কখনো সিঁতি কাটি নাই, এই ভয়ে যে, যাহার ভিতরে সৌন্দর্য্য নাই, সিঁতি তাহাকে কি সৌন্দর্য্য দিবে?
৫। আমি কখনো অলিক আমোদ প্রমোদে যোগদান করি নাই, এই হেতু যে, ইহা কু-প্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করে।
৬। জীবনে অনেক সময় অনেক বিকর্ষণ আসিয়াছে, যাহা হইতে রক্ষা পাইবার জন্য মহাপ্রভুর দরবারে মদদ চাহিয়াছি মনের বলের জন্য, সুপথে চলিবার জন্য এবং তাহা পাইয়াছি।
৭। একমাত্র বৈশবকালে যাত্রা গান শুনিয়াছি, আর একবার মাত্র যৌবনের প্রারম্ভে লোক দ্বারা প্রলব্ধ হইয়া থিয়েটার দেখিয়াছি। তৎপর খোদার দরবা হাত উঠাইয়া একরার করিয়াছি-হে খোদা, যে জিনিষের আকর্ষণ আমার ক্ষুদ্র শক্তিকে পরাস্ত করিতে চায়, সে জিনিস হইতে যেন সারা জীবন দূরে থাকিতে সমর্থ হই।
৮। নিজেকে ক্ষুদ্রতম মনে করিতে গৌরব বোধ করি। আঁ-হজরতের (দ:) দৃষ্টান্ত মনে করিয়া মেহতরের কাজ করিতেও সঙ্কোচ বোধ করি না। বরং ছুন্নত-পালন হেতু মনে এক অপরিসীম আনন্দ অনুভূত হয়।
৯। আঁ-হজরতের (দ:) ফরমান অনুসারে কাপড়ে যতক্ষণ তালি সহে, ততক্ষণ ইহা ব্যবহার করি এবং করিতেও আনন্দ বোধ করি।
১০। আহারকালে সব্বাগ্রে তিতো ও সস্বাশেষে মিষ্টি খাইতে ভালবাসি। ইহাতে ছুন্নত আদায় হয় ও অন্তরে প্রসাদ জন্মে।
১১। রাত্রিকালের আহার অন্তে “চেহেল কদমী” ক্ষুধার অনুকূল। ইহাতে বেশ উপকার বোধ করি।
১২। আহারে বসিবার কালে একজানু বা উভয় জানু উঁচু রাখিলে অত্যধিক ভোজনের কুফল হইতে রক্ষা পাওয়া যায়, এজন্য আমার নিকট উহা বেশ ভাল বোধ হয়।
১৩। আহার কালে শরীর ও মস্তক আবৃত থাকিলে ছুন্নত আদায় হয়। আমি ইহা অভ্যাস করিয়া আনন্দ পাই।
১৪। প্রত্যেক লোকমা লইবার সময় খোদার নেয়ামত মনে করিলে অন্তকরণটী ভরিয়া যায়, আর আহারান্তে শোকরিয়া সানন্দে আদায় করিতে ইচ্ছা হয়।
১৫। সর্ব্বদা শরীর ও মনকে পাক্্ রাখিতে পারিলে এক বিশুদ্ধ আনন্দ উপভোগ করা যায়, ছুন্নতও আদায় করা হয়।
১৬। অল্পাহারে শরীর হালকা বোধ হয়, রাত্রি জাগরণের সুবিধা হয়।
১৭। শয়নকালে দয়াময়কে ইয়াদ করিয়া, তাঁহারই অনুগ্রহ কামনা করিয়া দরুদ শরীফ পড়িতে পড়িতে নিদ্রা গেলে, রাত্রিটী ভালভাবে কাটে।
১৮। আয়াত কুরছী পড়িয়া শয়ন করিলে কুস্বপ্ন হইতে রক্ষা পাওয়া।
১৯। শয়নকালে খোদার নিকট তাহাজ্জদ পড়িবার ভিক্ষা মাঙ্গিলে ঠিক অভিপ্রেত সময়ে নিদ্রা ভাঙ্গিয়া যায়, কখনও কখনও স্বভাবও সাহায্য করে।
২০। রাক্রিকালে না-পাক অবস্থায় কাটাইলে মনে কলুষ জন্মে, ছুন্নতের খেলাফ হয়, অশন্তির সৃষ্টি হয়, স্বাস্থ্য ও ভঙ্গ হয়, তৎক্ষণাৎ অবগাহনে মনে স্ফূর্ত্তি হয়।
২১। দক্ষিণ কোরটে শয়ন করিলে কলব-এর উপর চাপ পড়ে না, পাছানফাছ আদায় করিতে সুবিধা হয়। মন না-পাক থাকিলে নানা ব্যাধির উৎপত্তি হয়, এবাদতে আনন্দ বোধ হয় না। দিবা-রাত্র সকল অবস্থায় পাক থাকা ছুন্নত।
২২। অধিক সময় নিদ্রিত থাকিলে এবাদতে অলসতা জন্মে, ঐশী প্রেমের লাঘব হয়।
২৩। পায়খানা প্র¯্রাব কালে যদি সূর্য্য কিংবা চন্দ্র সম্মুখে পড়ে, তবে খোদার নেয়ামতের উপর ঔদাস্য প্রদর্শিত হয়।
২৪। লোকের ব্যবহার্য্য স্থানে পায়খানা প্র¯্রাব করিলে লোকের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পায়, খোদাও অসন্তুষ্ট হয়।
২৫। প্র¯্রাব পায়খানার স্থানে অসৎ আত্মার বিচরণ হয়, সুতরাং যতটা নিজের সম্ভ্রম বজায় থাকে, আর যত সত্বর ঐ স্থান ত্যাগ করা যায় ততই শুভ। যাহাতে মনের মধ্যে কুভাবের প্রশ্রয় না হয়, তৎপ্রতি লক্ষ রাখা ভাল। ইহাতে ছুন্নত আদায় হয় ও দুশ্চিন্তা হইতে বাজ থাকা যায়।
২৬। মনোবৃত্তি এরূপে পরিচালিত করিতে হয়, যাহাতে কু-চিন্তার আসর না হয়। কু-চিন্তার রিপুগুলি পুষ্ট হয়, আর আত্মার ক্ষতি জন্মে।
২৭। পায়খানা প্র¯্রাবের পর তাজা ওজু করিলে মনে স্ফূর্ত্তি হয়। ওজুকে অর্ন্ধ অবগাহন মনে করা উচিত।
২৮। নিদ্রাকে লঘু করিলে এবাদতের জন্য অধিকতর সময় পাওয়া যায়। পাঁচ ঘণ্টার অধিক নিদ্রা সর্ব্বদা পরিত্যাজ্য। অভ্যাসকে যেরূপ করা যায়, সেইরূপ হয়। যাঁহারা তাহাজ্জদ-গোজার, তাঁহাদের পক্ষে নিদ্রা-বাহুল্য খুব ক্ষতিকর। তাহাজ্জদের সময় অতিবাহিত হইতে থাকিলে কানে অপরের আওয়াজ আসে, কখনো বা অপরের ডাক শুনা যায়, কখনো বা স্বভাবের বেগ ধারণ অসহ্য হইয়া পড়ে। ঐশী শক্তি যে প্রত্যেকের অন্তর্নিবিষ্ট, তাহা ঐ সময়ে বেশ অনুভূত হয়। নির্দ্ধারিত সময়ে নিদ্রিতকে জাগাইতে যেন ফেরেশতা নিয়োজিতই থাকেন।
২৯। যে এবাদতে মহব্বত নাই, তাহাতে দেল গলে না, মনে স্ফুর্ত্তি হয় না। কোরআন শরীফ বা দুরুদ শরীফ পাঠ করিলে খোদা ও রাছুল-এর প্রতি ভক্তি ও প্রেমের উন্মেষ হয়, আসন হইতে উঠিতে মন চায় না।
৩০। মোনাজাতকালে মনে করিতে হয়, যেন খোদা সবই শুনিতেছেন, বুঝিতেছেন, সুতরাং তাঁহারই দরবারে তাঁহারই মাহাত্ম্যের উপযোগী প্রার্থনা জ্ঞাপন করা ভাল। সেখানে হাট-বাজারের সাধারণ বিষয় ভিক্ষা চাওয়া মোনাজাতের গুরুত্বের খেলাফ। এই জন্য কামেল ব্যক্তি নিকটতমের নিকট যাচনা জানাইতেই নারাজ।
৩১। নামাজে খোদাকে হাজের নাজের মনে না করিলে নামাজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না।
৩২। নামাজের তরতিব এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত যে, উহা সম্পূর্ণ আদায় করিতে পারিলে মনে দীনতার উদয় হয়, খোদার মাহাত্ম্যে মনে জাগরিত হয়, মনোভাব বিনিময়ের সৌকর্য্য সাধিত হয়।
৩৩। হাকিমের নিকট উপস্থিত হইতে হইলে যেমন আকাঙ্খ্য বিষয় মনে করিতে হয়, সেইরূপ নামাজ আদায় করিবার পূর্ব্বে ওজু করিতেই প্রার্থিতব্য বিষয় মনে করিতে হয়। দুন্্ইয়াবী চিন্তাকে খায়ের-বাদ করিতে হয়।
৩৪। যে যে-বস্তুর আশেক, সে সর্ব্বদা সেই বস্তুকেই চিন্তা করে। কেউ বা অর্থ চিন্তা করে, কেউ বা সন্তান চিন্তা, কেউ বা স্ত্রী চিন্তা, কেউ বা সম্মান চিন্তা, কেউ বা বন্ধু চিন্তা, কেউ বা গণিকা চিন্তা, আর কেউ বা খোদা ও রাছুল চিন্তা করে। আমরা বেশ বুঝিতে পারি আমরা কাহার আশেক। পরকালে আমরা ঐ বস্তু পাইব, ইহকালে আমরা যে বস্তুর আশেক। কেউ বা খোদা ও রাছুলের দিদার পাইবে, আর কেউ বা দোজখে স্ব স্ব পূজিত রিপুর দহন ভোগ করিবে।
৩৫। চা, পান, তামাক আমার প্রিয় নহে। কোনো বস্তুর প্রতি অভ্যস্ত হইলে সেই বস্তু পূজ্য হইয়া উঠে, সর্ব্বদা তাহারই কথা মনে জাগে, সুতরাং ইহাও এবাদতের অন্তরায়।
৩৬। পার্থিব চিন্তা শরীরকে অবসন্ন করে, রিপুগুলিকে পুষ্ট করে। হিংসা, দ্বেষ, পরনিন্দা প্রভৃতি নফ্্ছকে পুষ্ট করে। আর ঐশী চিন্তা মনে প্রসাদ উৎপন্ন করে। তাই সংসারী চিন্তাকে পশ্চাদবর্ত্তী করিয়া পরমার্থ বস্তুর প্রতি মনকে নিয়োজিত করাই শ্রেয়।
৩৭। স্ত্রী, পুত্র, অর্থ, খাদ্য, স্বাস্থ্য সকলকেই ভালবাসি, কিন্তু দান হইতে দাতাকে অধিকতর ভালবাসিতে ইচ্ছা হয় ও তাহাতেই প্রকৃত আনন্দ পাওয়া যায়।
৩৮। ভক্ত দেখিলে তাহার পদধূলি চুমিতে ইচ্ছা হয়, তাহাকে মস্তকোপরি লইয়া নৃত্য করিতে মন চায়, তাহার পায়ের আঙ্গুলগুলি বক্ষের মধ্যে পুরিয়া রাখিতে ইচ্ছা হয়। যাহাকে ভালবাসা যায়, তাহার প্রিয় সকল বস্তুকে মন স্বতঃই ভালবাসিতে চায়।
৩৯। পরহেজগারী মনে, শরীরে নহে। মন পাক্্ না থাকিলে কেবল শরীরকে পাক্্ রাখিবার চেষ্ট বৃথা। পবিত্র মনে আয়াত শরীফ বা দরুদ শরীফ পরিয়া কোনো বস্তুতে দম করিলে ফায়দা হয়, কেন হয় বুঝি না, ফল দেখিয়া অনেক সময় বিস্মিত হই, স্বীয় হীনত্ব অনুভূত হয় আর খোদার মহত্ত¡ উপলব্ধ হয়।
৪০। কোরআন শরীফকে খোদার খাস দান মনে করি। উহাকে তাজিম করিলে খোদাকে তাজিম করা হয়। ভক্তের কথা কত ভাল লাগে, আর ভক্তিময়ের কথা কত সহ¯্র গুণে ভাল, কেউ কি তাহার মর্য্যাদা বুঝে? কোনো বোজর্গের পত্র পেলে কত তাজিম করি, আর স্বয়ং খোদার কালেমের প্রতি কত তাজিম, কত ভক্তি, কত শ্রদ্ধা করা উচিত! তেলাওয়াতে মনে নূতন প্রেরণা জন্মে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি হয়, বার্দ্ধক্যের ভার লঘু হয়, ব্যাধি নিরাময় হয়, কার্য্যে উদ্যম জন্মে।
৪১। প্রত্যেক দিন প্রাতে দরুদ শরীফ ও তৎসহ খোদার কালাম কিছু না পড়িলে মনে শান্তি পাই না, কাজেও আগ্রহ আসে না।
৪২। যখন পাখী “হক কথা কও” “পীউ কাঁহা” বলিয়া উড়িয়া যাইতে দেখি, তখন তাহার সাথে উধাও হইয়া উড়িতে ইচ্ছ হয়। যখন মোরগ তাহাজ্জদের ওয়াক্তে মানুষকে নিদ্রা হইতে জাগাইয়া দেয়, তখন ¯্রষ্টার প্রতি কি পবিত্র প্রেমের সঞ্চার হয়; যখন হাঁস, কবুতর, শালিককে প্রেমাবদ্ধ হইয়া জোড়া জোড়া চরিতে দেখি, তখন মনে কি প্রেমের তরঙ্গ উথলিয়া উঠে।
৪৩। যখন ক্ষুদ্র ঘাস-ফুলের মধ্যে অচিন্ত্য শিল্পের পরিচয় পাই, যখন গোলাপের সুগন্ধ মনকে ভরপুর করে, যখন পাতাবাহার দৃষ্টিশক্তিকে হরণ করে, যখন পাখীর কূজন কর্ণ কুহরকে তৃপ্ত করে, যখন প্রাতঃকালীন বা সান্ধ্য হিল্লোল শরীরকে শীতল করে, তখন চকিতে দয়াময়ের অফুরন্ত দয়ার কথা মনে পড়ে। তাঁহার সৃষ্টিকৌশল আত্মাকে মুগ্ধ করা, বুক ধড়ফড় করিতে থাকে, আর প্রেমময়ের সান্নিধ্য কলবকে তোলপাড় করে।
৪৪। যখন খোদা তাঁহারই আয়াত শরীফের অছিলায় কাহাকেও ব্যাধি হইতে মুক্ত করেন, সে মানুষ হউক, পশু হউক, আর উদ্ভিদ হউক, তখন কৃতজ্ঞতা-রসে সারা হৃদয়টী আপ্লুত হয়। আর খোদাকে বুকের মধ্যে পুরিয়া কত সোহাগ করিতে ইচ্ছা জন্মে।
৪৫। আমি সুগন্ধি ভালবাসি, পুষ্প দেখিতে ভালবাসি, পরিষ্কৃত পরিচ্ছন্ন থাকিতে ভালবাসি। ইহাতে খোদারই এহ্্ছান মনে জাগরূক থাকে।
৪৬। আমি চরিত্র গঠনকে এবাদতের প্রধান অঙ্গ মনে করি। যার চরিত্র গঠিত নয়, তার এবাদত বেকার।
৪৭। একই হৃদয়ে খোদী ও খোদার মিলন অসম্ভব। হয় খোদীকে ছাড়িয়া খোদাকে এখতেয়ার করো, না হয় খোদাকে ছাড়িয়া খোদী বা আমিত্ব নিয়ে থাকো। আমিত্ব থাকিতে খোদার উপর মহব্বত কায়েম হয় না, শরীয়তপন্থী আমিত্ব-পূজক, তরীকত পন্থী খোদার পূজক।
৪৮। মহব্বত পোখ্তা হইলে তছদিক জন্মে, খোদার এককত্ব অনুভূত হয়, তাওহিদ-জ্ঞান লাভ হয়। মহব্বতই আমার একমাত্র শিক্ষা, এখমাত্র দীক্ষা।
৪৯। আঁ-হজরতের প্রতি অটল ভক্তি না জন্মিলে তাঁহার উম্মতের দাবী করা যায় না, পরকালে মুক্তিরও আশা করা যায় না। তাঁহারই দয়া আমার জীবনের একমাত্র সম্বল।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) আমার জীবনধারা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, পৃঃ ১৩২-৩৩৭।
অপরের খেদমত করাই ইহার উদ্দেশ্য; অন্য উদ্দেশ্য হইতেছেভ্রাতৃত্ব স্থাপন, দুঃখীর অভাব নিরাকরণ, শিশু ও বয়স্কদিগের দীনিয়াত শিক্ষাদান, পরদা সংরক্ষণ, পল্লী-উন্নয়ন ইত্যাদি। মিশন প্রতিষ্ঠাতা হজরত খানবাহাদুর আহছানউল্লা (র:) প্রতিষ্ঠাকালীন মিশনের কার্যক্রম সম্পর্কে নি¤œরূপ বর্ণনা দিয়েছেন।
“ইত্যবসরে (১৯৩৫ সালে) একটী মিশন স্থাপন করিলাম। মিঞা আবদুছ ছোবহান ইহাতে যোগদান করিল। খান ছাহেব শৌলবী আবদুল করিম ছাহেব এই মিশন গঠন-কার্য্যে সহযোগিতা করিলেন। তিনি ইহার মিয়মাবলী এবং কার্য্যক্রম ইত্যাদি লিখিলেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক যুবকবৃন্দ হইবার মেম্বার হইল। মৃত দেহের সৎকার, কলেমাখানি, রাস্তাঘাট নির্ম্মাণ কার্য্যরে দিকে মিশনের দৃষ্টি পড়িল। মিশন নিঃস্বার্থে পরোপকারে ব্রতী হইল। মিশনের কার্য্যকরিতা দেখিয়া ইহার প্রতি বয়োবৃদ্ধদের মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। মিঞা কুচলুদ্দীন খাঁ, ডাক্তার মাহতাব উদ্দীন প্রভৃতি ক্রমে ইহাতে যোগ দিলেন। মিশনে অনেকে উপস্থিত হইয়া মৃতপ্রায় প্রাণে নূতন প্রেরণা উদ্দীপ্ত করিত ও দরুদ পার্টির আয়োজন করিয়া রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত। ইহাতে খোদার ফজলে কলেরা প্রশমিত হইত, লোকের মনে নূতন বলের সঞ্চার হইত। মিঞা মজনু স্বয়ং কাফনের কাপড় সেলাই করিতেন, গোছল ও জানাজার ব্যবস্থা করিতেন। কিন্তু কাহারও নিকট হইতে পয়সা কড়ি লইতেন না। ইহার ফলে মিশন শক্তিশালী হইয়া উঠিল। নূতন নূতন মেম্বর লিষ্টভুক্ত হইতে থাকিল।
এতদ্ব্যতীত বাদ জুমার নামাজ দরুদ শরীফ আবৃত্তি করা হইত ও হৃদয়গ্রাহী গজল গঠিত হইত। প্রতি মাসে চাঁদের ১১ই তারিখে হজরত গওছোল আজম্্ (র:) এর ওরছ শরীফের স্মৃতি উপলক্ষ্যে গ্যারুই শরীফের মিলাদ উৎসব সংঘটিত হইত। ঐ উপলক্ষ্যে তাঁহার জীবনী আলোচিত ও তাঁহার অমিয় উপদেশ বাণী বর্ণিত হইত। মিশনের উদ্যোগে সর্ব্বদা মিলাদ শরীফের ব্যবস্থা হইতে থাকে। সেই উপলক্ষ্যে আঁ-হজরতের বিস্তৃত জীবনীর এক এক অংশ বর্ণিত হইত।
ক্রমে অন্যান্য গ্রামেও নলতার অনুকরণে মিশন গঠিত হইল। মেম্বরদিগের মধ্যে একতা ও সৌহার্য্য বর্দ্ধিত করিবার চেষ্টা হইল। যে সকল স্থানে পুরুষানুক্রমে বিবাদ-বিসংবাদ এবং আত্মকলহ প্রচলিত ছিল, মিশন-কর্ম্মীদের অক্লান্ত চেষ্টায় সেখানে শান্তির সৃষ্টি হইল।
(সূত্র ঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) আমার জীবনধারা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, পৃঃ ১১২-১১৩)
“আমরা দ্বারে দ্বারে মুষ্টি” ভিক্ষা করি এবং মুষ্টির চাউল বিক্রয় করিশিক্ষকের বেতন দেই, শ্রমিক বেশে স্বয়ং রাস্তা ঘাট প্রস্তুত করি, নামাজ শিক্ষার ব্যবস্থা করি, মিলাদ শরিফের প্রচলন দ্বারা রোগ শোক প্রশমিত করি, দুঃস্থ ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করি ইত্যাদি। উদ্বৃত্ত তহবিল পোষ্টাল ব্যাংকে জমা দিবার ব্যবস্থা আছে, হিসাব অডিট করিবার প্রথা আছে, আবশ্যক মতে অভাব অভিযোগের প্রতি কর্তৃপক্ষের দুষ্টি আকৃষ্ট করা হয়। স্থানে স্থানে মিশনের শাখা সৃষ্ট হইয়াছে। মেম্বরদিগের মধ্যে হাম-দরদী, ভ্রাতৃত্বভাব নিরহঙ্কার ও ত্যাগ-স্পৃহা মিশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যুবকেরাই মিশনের স্তম্ভস্বরূপ।
খেদমত করাই মিশনে একমাত্র কর্ত্তব্য। আমরা খাদেম হইতে ভালবাসি। পীর সাজিয়া অপরের খেদমত গ্রহণ করা অপছন্দ করি। স্থানে স্থানে সেবক-সমিতি গঠন করিয়া জনসাধারণের সেবায় জীবনকে নিয়োগ করাই আমাদে অভিপ্রেত। আমরা সমাজের আশীষ চাই, যেন সারা জীবন সেবায় ব্রতী থাকিতে পারি। আমরা খাদেম হইয়া থাকিতে গৌরব বোধ করি।
সাম্য, একতা ও ভ্রাতৃত্ব আমাদের চরম লক্ষ্য। শ্রমিক বেশে রাস্তা তৈয়ারী করিব, আর সেই রাস্তার আশেকের পদ-ধূলি বক্ষে লইয়া চরিতার্থ হইব, ক্ষুদ্র আমরামহা দরবারে শোকরিয়া আদয়ি করিব! খাদেম হইয় আমরা মানুষের মনকে জয় করিব, বক্তৃতার দ্বারা নয়কার্য্যরে দ্বারা। আমরা ভিক্ষুক বেশে চাউল কুড়াইয়া দুঃস্থের দেহে কাপড় যোগাইব, আমরা দরূদ শরীফ আবৃত্তি করিয়া ব্যাধি পীড়া অপনোদন করিব, আমরা প্রেমের পথ দিয়া ছোট বড় সবাইকে সঙ্গে লইয়া সত্যময়কে অনুসন্ধান করিব, সত্যই আমাদের সহায় হইবে, লোকের ভ্রƒকুটী আমাদিগকে দমাইতে পারিবে না। আমাদের পথের সম্বল হইবে “লা এলাহা ইল্লাল্লাহ, আমীন!”
(সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, পৃঃ ১৯-১২০)
১। অল্প আহার করিবে, কথা কম বলিবে ও কম নিদ্রা যাইবে। কাহাকেও হেয় জ্ঞান কেিব না, কাহারও গীবত করিবে না এবং কাহারও অন্তরে ব্যাথা দিবে না। সত্য বলিবে, সততা অবলম্বন করিবে ও শত্রæকে মিত্রতা দ্বারা বশীভূত করিবে। রোগ, শোক সকল অবস্থায় বিলাইয়া দিয়ো ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাতে বিলীন হইবে। হাস্তিজ্ঞান, অহমিকা ও রিয়া সর্ব্বদা বর্জ্জন করিবে। নিজেকে ক্ষুদ্রমত ও অপরাধী মনে করিবে। শরীর ও মন উভয়কে পাক রাখিবে। সর্ব্বদা বা-অজু থাকিতে চেষ্টা করিবে। ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করিবে। স্বীয় আমল দুরস্ত রাখিবে। যে বস্তুর আমল কর নাই কাহাকেও তাহা আদেশ করিবে না। সকল তরীকাকে সমচক্ষে দেখিবে এবং প্রত্যেকটিকে খোদাপ্রাপ্তির পথ মনে করিবে। অযথা তর্ক করিবে না। কাহাকেও কাফের বলিবে না। প্রতি শ^াস-প্রশাসে খোদাকেই ইয়াদ করিবে। শয়ন করিবার পূর্ব্বে অজু করিবে এবং দরূদ শরীফ ও কলেমা শরীফ ইয়াদ করিবে।
২। আউয়াল ওয়াক্তে নামাজ আদায় করিবে। নিজের ক্রটি মনে করিয়া ক্ষমাপ্রার্থীর মত নামাজ আদায় করিবে। দুনিয়াবী চিন্তা বর্জ্জন করিতে চেষ্টা করিবে। ধীরে ধীরে সেজদা দিবে এবং অর্থের প্রতি লক্ষ্য লাখিবে। অজিফার সময়ে চোখ বন্ধ করিয়া খোদাকে স্মরণ করতঃ কলবের দিকে নজর করিবে। নামাজের সময় নিজেকে অপরাধী মনে করিবে ও অলসতা ত্যাগ করিবে। অশ্রæকে ভূষণ করিবে। নামাজে এমনভাবে মনোনিবেশ করিবে যেন একটি আলপিনের শব্দও অন্তরায় বলিয়া অনুভূত হয়। অযথা হাই তুলিবে না বা আঙ্গুল মটকাইবে না। হ্যঁচিকে দমন করিতে চেষ্টা করিবে। যে নামাজে মনটি প্রবিষ্ট হয় সে নামাজে অধিক সময় ব্যাপৃত থাকিবে। সামর্থ্য মত খাড়া হইয়া নফল নামাজ আদায় করিবে এবং স্মরণ রাখিবে ইহাতে দ্বিগুণ ছওয়াব হাছেল হয়।
৩। জামাতে নামাজ আদায় করিবে ও মনে রাখিবে ইহাতে ২৭ গুন নেকী হাছিল হইবে। মসজিদের ভিতরে কখনও গল্পগুজব করিবে না। মনে রাখিবে সকলের এবাদত মসজিদে অদ্্শ্যভাবে স্তূপীকৃত থাকে। সর্ব্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে নামাজ আদায় করিবে।
৪। মনের মধ্যে কুচিন্তা আসিলে মাহবুবকে ইয়াদ করিবে। একাকী শেষ রাতে ১২ রাকাত তাহাজ্জদ নামাজ আদায় করিবে। তৎপর অন্ততঃ দশ মিনিট কান মোরাকেবা বা ধ্যানে বসিবে। মনে মনে বলিবে “আল্লাহু হাজেরী, আল্লাহু নাজেরী, আল্লাহু মা’য়ী,” কিন্তু চোখ বন্ধ থাকিবে। মুখ নড়িবে না। সমস্ত শরীর হালকা করিবে এবং খোদা ব্যতীত সকল চিন্তাকে কুফরী মনে করিবে। যে-অজু, পাকী বা না-পাকী সকল অবস্থায় মনে মনে বলিবে ‘লা এলাহা’ উর্দ্ধশ^াসে এবং ‘ইল্লাল্লাহ’ নি¤œশ^াসে।
৫। ধ্যানের সময় চিন্তা¯্রােতকে কেবল খোদাতেই নিয়োজিত করিবে। তাহাজ্জদ নামাজের পর এক বা স্বতন্ত্র বৈঠকে ফজরের নামাজ আদায় করিবে। ফজরের সুন্নত নামাজকে খুবই প্রাধান্য দিবে এবং স্বততঃ খাড়া হইয়া আদায় করিবে। নামাজে ভাবাবেশ হইলে স্বতঃই চোখ বন্ধ হইয়া আসিবে। বাহ্যিক আওয়াজের প্রতি লক্ষ্য রাখিবে না।
৬। শরীয়তের মধ্যে নামাজকে শ্রেষ্ঠ স্থান দিবে। বার্ষিক আয়ের হিসাব করিয়া প্রতি বৎসর বিনা আড়ম্বরে জাকাত আদায় করিবে। আঁ-হজরতের ক্বওল, ফেলকে যথাসম্ভব আয়ত্ব করিবে।
৭। কোন উৎপীড়নে উহ্ শব্দটি করিবে না। কোন শত্রæকে ঘৃণা করিবে না। শত্রæর মল পর্য্যন্ত আনন্দে পরিষ্কার করিতে প্রস্তুত থাকিবে।
৮। সংসারী হওয়াও ত্যাগী থাকিবে। সংসারের মোহে আবদ্ধ হইবে না। স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে খোদার দান মনে করিয়া স্বযতেœ লালন পালন করিবে। কিন্তু কদাপি দানকে দাতার উপর স্থান দিবে না। সর্ব্বদা ¯্রষ্টা ও সৃষ্টের মধ্যে আসমান জমীন ফারাক মনে করিবে।
৯। আঁ-হযরত ও স্বীয় পীরকে খোদার কাছ পেয়ারা মনে করিবে এবং খোদা, রছুল ও পীরের প্রতি সমভাবে দৃষ্টি রাখিবে। স্বপ্নাবেশে অলি আল্লাহগণের জেয়ারত কামনা করিবে।
১০। রমজান মাসের শেষভাগে এতেকাফ এখতেয়ার করিবে। খোদার খাছপেয়ারা বান্দাসহ মসজিদে তামাম দিন রাত এবাদতে ব্রতী থাকিবে। কেবল পায়খানা প্রশ্রাবের জন্য বাহিরে যাইবে কিন্তু ভুলেও কাহারও সহিত কথা বরিবে না। দৃষ্টি ভূমির দিকে রাখিবে।
১১। ফজরের নামাজের পর বেলা ৮ ঘটিকায় ৪ রাকাত এশরাক, দশ ঘটিকায় ৪ রাকাত চাশত, জোহরের নামাজের পর ছালাতুত তসবিহ ৪ রাকাত, প্রত্যেক রাকাতে ৭৫ বার দোয়া সোবহানাল্লাহ, মাগরিবের নামজের বাদ আওয়াবিনের ৬ রাকাত নামাজ, প্রত্যেক রাকাতে ছুরা ফাতেহার পর ৩ বার ছুরা এখলাছ, প্রত্যেক ২ রাকাত বাদ ছালাম।
১২। মহব্বতকে দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ট সম্বল মনে করিবে এবং মহব্বতে নিজেকে এরূপ নিমগ্ন রাখিবে যে সকল সময় চোখের সামনে মাহবুব দৃষ্টিগোচর হয়। মহব্বত অগ্নি স্বরূপ, সকল কুচিন্তাকে জ¦ালাইয়া খাক্্ করিয়া দেয়। যাহাকে মহব্বত করিবে তাহারই হইয়া যাইবে। যাহাকে ভালবাসিবে আখেরাতে তাহার সঙ্গলাভ করিবে। নিজেকে এরূপভাবে তৈয়ার করিবে যেন দেহত্যাগের পর বেহেস্তের সর্ব্ব-উচ্চ পর্য্যায়ে স্থান লাভ করিতে পারে। সর্ব্বদা মনে রাখিবে নেকী ও সুচিন্তার মান অনুসারে জান্নাতে স্থান নির্দিষ্ট হয়।
১৩। দুনিয়ার মধ্যে আখেরাতকে লাভ করিবার চেষ্টা করিবে। এই দুনিয়াকে আখেরাতের সূচিকা মনে করিবে।
১৪। স্বপ্নে যাহা লাভ কর খোদার পেয়ারা ব্যক্তি ব্যতীত অপরকে বলিবে না। প্রশান্ত অন্তরে রোজা রাখিতে চেষ্টা করিবে বৎসরে কেবল ৫ দিন ব্যতীত।
১৫। যখন মোনাজাত করিবে তখন কেবল নিজের জন্য করিবে না। অপরের জন্যও মোনাজাত করিবে। কৃপণতাকে মহাপাপ মনে করিবে।
১৬। জাকাত, ফেতরা ও খয়রাত যথাসম্ভব আদায় করিবে। অভাবকে সম্পদ মনে করিবে এবং অভাবের মধ্যেই খোদার নিকটতর হইতে চেষ্টা করিবে।
১৭। সর্ব্বদা মনে রাখিবে ধন অতি চঞ্চল। কোন পরিবারের মধ্যে দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকে না। সুতরাং উহাকে অযথা আবন্ধ করিবার চেষ্টা করিবে না।
১৮। ঋণ হইতে সর্ব্বদা দূরে থাকিবে। ঋণগ্রস্ত হইলে শীঘ্রই মুক্তির প্রয়াসী হইবে।
১৯। মনে রাখিবে প্রত্যেকটি বদী, প্রত্যেকটি কুচিন্তা রুহের উপর প্রতিফলিত হয়। যতই রুহের মলিনতা দূর হইবে ততই করুণাময়ের আকর্ষণ বর্দ্ধিত হইবে।
২০। তরীকত খোদাপ্রাপ্তির প্রথম সোপান। শরীয়তকে তরীকতে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবে। কলেমা তৈয়ব মুখে আবৃত্তি করিলে শরীয়ত আদায় হয় কিন্তু তরীকত আদায় হয় না যে পর্যন্ত ¯্রষ্টা ব্যতীত গায়ের খোদার অধিক মহব্বত থাকে। কলেমা শুদ্ধ অন্তরে, শুদ্ধ মনে আদায় করিলে অপ্রত্যাশিত ফল লাভ হয় দুনিয়ার মধ্যে। একছুয়ী (একাগ্রতা) না থাকিলে নামাজ তরীকতে পরিণত হয় না। হুজুরী দেল তরীকতের মুখ্য উদ্দেশ্য। শরীয়তের জাকাত শতকরা আড়াই টাকা কিন্তু তরীকতের জাকাত সমগ্র জীবনটি দিলেও আদায় হয় না। দিবাভগে আনাহার থাকিলে শরীয়তের রোজা আদায় হয়। তরীকতের জন্য অধিক আহার, অধিক নিদ্রা ও কুচিন্তা অন্তরায় স্বরূপ। কাবা শরীফ জেয়ারত করিলে শরীয়তের হজ্জ আদায় হয় কিন্তু নিজেকে খোদার উপর বিলাইয়া না দিলে তরীকতের হজ্জ আদায় হয় না।
২১। এতিমের প্রতি হামদরদি প্রকাশ করিবে ও তাহাদের হক্্ রক্ষা করিবে।
২২। সত্য কখন, সত্য প্রচার, সৎগ্রন্থ পাঠ ও সৎসঙ্গ লাভ করিবে।
২৩। সর্ব্ববিধ নেশা বর্জ্জন ও ত্যাগ করিবে।
২৪। আত্মাভিমান বর্জ্জন, সম্পদে বিপদে খোদার উপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা এখতেয়ার করিবে।
২৫। কথা ও কার্য্য দ্বারা নিঃস্বার্থে পরোপকার করিবে।
২৬। স্বার্থের জন্য কাহারও নিকট হস্ত প্রসার করিবে না।
২৭। কেবল কুকার্য্য নহে কুচিন্তা হইতেও নিজেকে রক্ষা করিবে। সর্ব্বদা মনে রাখিবে উভয়ই খোদার নিকট সমভাবে বিচার্য্য।
২৮। নিজেকে ক্ষুদ্রতম মনে করিবে, কাহাকেও তুচ্ছ বা ঘৃণা করিবে নাসে নফর হউক, ভক্ত হউক বা শিষ্য হউক।
২৯। সুকথা ও সুকার্য্য দ্বারা লোকের সন্তুষ্টি সাধন করিবে এবং কুকথা ও কুকার্য্য দ্বারা কাহারও অন্তরে ব্যথা দিবে না।
৩০। মঙ্গল ও অমঙ্গলকে সমচক্ষে দেখিবে। সকল অবস্থাতেই শোকর গুজার করিবে।
৩১। নির্জ্জনে গভীর রাত্রিতে তাহাজ্জদ আদায় করিবে ও মোরাকেবা সাধন করিবে এবং পার্থিব চিন্তাস্রোত হইতে বিমুক্ত হইয়া মহাপ্রভুর চিন্তায় বিলীন হইবে।
৩২। মোরাকেবার অর্থ মনঃসংযোগ। সমস্ত অন্তর দিয়া মহাপ্রভুকে চিন্তা করা এবং ঐশী চিন্তায় নিমজ্জিত হইয়া স্বীয় হাস্তি জ্ঞানকে লোপ করাই প্রধান উদ্দেশ্য। ইহাই তাওহীদ নামে অভিহিত। ইহাই মুছলমানদের শীর্ষস্তর। প্রেমিক ও প্রেমময়ের সংযোগ সাধন, সাযুজ্য ও তন্ময়তালাভ মারেফতের প্রধান লক্ষ্য।
৩৩। মহব্বতই তরীকতের মূল। শরীয়তের উদ্দেশ্য বেহেশত্্ প্রাপ্তি আর তরীকতের উদ্দেশ্য খোদাপ্রাপ্তি। প্রেমই প্রেমিক ও প্রেমময়ের মধ্যে সংযোগ সাধন করিয়া দেয়। মহব্বতের মূলে চরিত্র গঠন। চরিত্র গঠিত হইলে বান্দা মহব্বতের যোগে খোদাওয়ান্দ করিমের সান্নিধ্য হাসেল করিতে পারে। মহব্বতে অধিকার জন্মিলে প্রেমিক খোয়াবের যোগে ঐশী তথ্যের নিদর্শন লাভ করে। মহব্বতের প্রাখর্য্য হইলে তরীকত হকিকতে ও হকিকত মারেফতে উন্নীত হয় এবং নানাবিধ অলৌকিক দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয় এবং ধরাবক্ষে প্রেমিক প্রকৃত শান্তির অধিকারী হয়। খোয়ার নবুয়তের একটি অংশ। বওয়ায়েত নবুয়ত খতম হইলে সোবাশ্্ সেরাত (নাম লোকের খোয়াব) খতম হয় নাই। খোয়াবের ৩টি শর্তপরহেজগার হওয়া, নেক হওয়া, জাকের হওয়া। ডাইন কোরাটে বা-অজু শয়ন; হালালখোরী ও সত্যবাদী হওয়া আবশ্যক। নিদ্রিত আবস্থায় মানুষের রুহ অবসরপ্রোপ্ত হয়, তখন সশরীরে বা সূ² শরীরে আধ্যাত্মিক ধামে চলিয়া যায়। নেক ও পরহেজগার ব্যক্তি নিদ্রাযোগে যে ঘটনাবলী দেখেন তাহা সত্য ও ফলদায়ক। শেষ রাত্রির খোয়াব সাধারণতঃ ব্যর্থ হয় না। চাঁদের ৬, ৭, ৯, ১৫, ১৮, ১৯, ২২ ও ২৭ তারিখের খোয়াব সত্য হয়। মিথ্যাবাদী ও বেপরহেজগার লোকের খোয়াব ফলদায়ক হয় না।
‘আমার পর নবুয়ত থাকিবে না কিন্তু সুসংবাদাদি স্থায়ী থাকিবে যাহা মোমেন ব্যক্তি নিদ্রাযোগে দেখিবে বা দেখান যাইবে।’ (হাদিছ)
‘যে আমার স্বপ্ন দেখিয়াছে প্রকৃতপক্ষে সে আমাকে দেখিয়াছে। শয়তান আমার ছুরত বা হকিকতের ও বহিরতের নূর প্রাপ্ত ব্যক্তির আকৃতি ধারণ করিতে পাবে না।’ (হাদিছ)
৩৪। সকলের উদ্দেশ্য হইবে খোদাপ্রাপ্তি মহব্বতের রশি দ্বারা রছুলুল্লাহ (স:) ও অলি আল্লাহগণের মাধ্যমে। প্রশংসার মোহ ত্যাগ করিয়া সর্ব্বান্তঃকরণে সৃষ্টের সেবা ও ¯্রষ্টার সন্তুষ্টি সাধন সকলের একমাত্র আকাক্সক্ষা হইবে।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) (২০০১), আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন (২০০১); পৃ: ২২-২৬।
১। শরীয়ত ও তরীকত পরস্পর সংশ্লিষ্ট। শরীয়ত হইতেছে ভিত্তি (ঋড়ঁহফধঃরড়হ), আর তরীকত হইতেছে কাঠামো (ঝঃৎঁপঃঁৎব)। শরীয়ত যত মজবুত হইবে, তরীকত ততই পোখ্তা হইবে। শরীয়ত পাঁচটি স্তম্ভের উপরস্থিত, যথাকলেমা, নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ্জ। প্রথম তিনটি সর্ব্বসাধারণের জন্য মনোনীত, জাকাত ও হজ্জ সম্পন্ন-ব্যক্তির পালনীয়।
২। তরীকতে অগ্রসর হইলে শরীয়তের পাবন্দ হওয়া আবশ্যক। তরীকতের প্রথম পাঠ মহব্বতখোদার উপর মহব্বত, রছুলের উপর মহব্বত, পীরের উপর মহব্বত, অবশেষে সৃষ্টির উপর মহব্বত।
৩। ২য় পাঠচরিত্র গঠন। যাহার চরিত্র নাই, তাহার কিছুই নাই। তাহার শরীয়ত ও তরীকত উভয়ই নিষ্ফল।
৪। ৩য় পাঠচরিত্র গঠিত হইলে খোদীকে (আমিত্বকে) বর্জ্জন করিতে হইবে, নিজকে ক্ষুদ্রতম মনে করিতে হইবে, অভিমানকে বিদায় দিতে হইবে, অপরের জন্য স্বার্থকে বলি দিতে হইবে।
৫। ৪র্থ পাঠরেয়াজাত (কৃচ্ছু-সাধন)। আজকার ও আশগাল, মোরাকেবা, তছোওয়ার, অতিরিক্ত নামাজ, অতিরিক্ত রোজা, দরূদ শরীফ, আবৃত্তি, তফক্কোর, নির্জ্জনবাস ও নিজ্জন চিন্তা।
৬। নফ্্ছকে (কুপ্রবৃত্তিকে) ফানা করাই তরীকতের উদ্দেশ্য। হাদিছে আছে ‘মুতু কাবলা আন্্তামুতু’ অর্থাৎ ‘মওতের পূর্ব্বে মরো’। নফছ বশীভূত না হইলে মা’রেফত হাছেল হয় না। শুষ্ক শরীয়ত খোদার নৈকট্য লাভ করিতে অসমর্থ। যতই নফছ আয়ত্ত¡াধীন হইবে, যতই আমিত্বের বিনাশ হইবে, ততই ঐশী মহব্বত বাড়িতে থাকিবে এবং ততই খোদার ভেদ (রহস্য) অনুভূত হইবে।
৭। খোদার কুদরতী নূরে হজরত মোহাম্মদ (দ:) সৃষ্ট হইয়াছেন এবং সেই নূর হজরত আদম হইতে ক্রমান্বয়ে নবীদের মধ্যে বিকশিত হইয়াছে। অবশেষে বেলায়েতরূপে অলি-আল্লাহগণের মধ্যে বিকাশ লাভ করিয়াছে।
৮। হাফেজ সিরাজী আলায়হের রহমত বলিয়াছেন, ‘মুর্শিদের কৃপাদৃষ্টি দ্বারা (মৃত্তিকাতুল্য) মুরিদ কিমিয়া বা স্বর্ণে পরিণত হয়।’ পীরের তোওয়াজ্জ্বাহ হইলে মুরীদের মধ্যে পীরের রূপ ও গুণের প্রকাশ হয়, ইহাই তাছাওউফের বিধান। আঁ-হজরত (দ:) ফরমাইয়াছেন, উম্মতের পক্ষে নবী যেরূপ, মুরীদের পক্ষে পীরও তদ্রƒপ।
৯। জনৈক কবি বলিয়াছেন‘পীরের জাহেরী ছুরত তাঁহার আসল রূপ নহে। তাঁহার মধ্যে আল্লাহ্তায়ালার যে সৌন্দর্য্য বিকাশ হয়, তাহা সাধানা ব্যতীত দেখিতে পাওয়া যায় না।’
১০। খোদার কুদরতে পীর একই সময়ে বহু আত্মাকে মোস্তাফিজ করিতে পারেন।
হাদিছ: ‘আল ইন্্ছানো ছিররী ও আনা ছিররুছঅর্থাৎ এনছান আমার ভেদ আর আমি মানুষের ভেদ। কামেল মুর্শিদ খোদার হাবিব, তাঁহার সুনজর হইলে খোদার মা‘রেফত দৃষ্টিগোচর হয়।
১১। মুর্শিদ দুনিয়ার বুকে ভক্তগণকে যেমন শিক্ষা দেন, মৃত্যুর পরেও আশেকগণের তদ্রƒপ মনস্কামনা পূর্ণ করেন। অলি-আল্লাহ মরিয়াও জিন্দা থাকেন।
১২। আশেক খোদারই এককত্বে নিজেকে নিমজ্জিত করে। তাঁহার নিকট একই হাস্তি কায়েম আর সব হাস্তি (খোদা ব্যতীত) অনিত্য। তাই কথিত আছে‘মান আরাফা নাফছাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’যে ব্যক্তি নিজেকে চিনিয়াছে, নিশ্চয়ই সে তাহার প্রতিপালককে চিনিয়াছে।
১৩। আরেফ (তত্বজ্ঞ) যতই উন্নত হউক না কেন, খোদার স্বরূপ চিনিতে অক্ষম। সসীম মানব অসীম খোদার সম্যক ভেদ বুঝিতে পারে না।
হাদিছ : ‘হে প্রভো, তোমাকে যেমন চেনা প্রয়োজন, আমি তোমাকে তেমন চিনিতে পারি নাই।’
১৪। আল্লাহতায়ালার জাত ও ছেফাত অনন্ত ও অসীম, সুতরাং তাঁহার পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা কোনো অরেফের পক্ষে সম্ভব নহে।
সূত্রঃ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) (২০০১), আহ্ছানিয়া মিশনের মত ও পথ, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন; পৃ: ২১-২২।